ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

উত্তাল মার্চ

পাকিস্তান দিবস হয়ে উঠল প্রতিরোধ দিবস

পাকিস্তান দিবস হয়ে উঠল প্রতিরোধ দিবস

২৩ মার্চ প্রতি বছর পালিত হতো পাকিস্তান দিবস হিসেবে। এদিন ভোরে দেশের সব সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো, আয়োজিত হতো কুচকাওয়াজ, সভা সমাবেশ ও নানা অনুষ্ঠান। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন সেবারের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস হিসেবে নয়, পালিত হবে প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে এদিন ভোর ৬টায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ছাত্র-জনতা প্রভাতফেরি বের করে। প্রভাতফেরিটি আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে ভাষাশহিদদের কবর, শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হকসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহিদদের কবর জিয়ারত করে। এ সময় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। ভোরে রাজধানীর সচিবালয়, হাইকোর্ট, সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সসহ বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার পাশাপাশি কালো পতাকাও উত্তোলন করা হয়। একমাত্র প্রেসিডেন্ট ভবন, গভর্নর হাউস, ক্যান্টনমেন্ট ও তেজগাঁও বিমানবন্দরেই কড়া নিরাপত্তার মাঝে এদিন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সকাল ৯টায় আউটার স্টেডিয়ামে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জয় বাংলা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ এবং যুদ্ধের মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ঢাকা পরিণত হয় পতাকার নগরীতে। ভোর থেকেই ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী, চাকরিজীবী, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনতার একের পর এক মিছিল বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারের বাড়ির সামনে জড়ো হতে থাকে। মিছিলে শামিল হওয়া সর্বস্তরের জনতার হাতে হাতে ছিল বাঁশ, লাঠিসহ নানা দেশীয় অস্ত্র। জনতার কণ্ঠে ছিল সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান এবং জয় বাংলা স্লোগান। সকালে ধানমন্ডির বাসভবনে শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। একইসঙ্গে উড়ানো হয় কালো পতাকাও। এসময় সমবেত কণ্ঠে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি পরিবেশিত হয়। পতাকা উত্তোলন শেষে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা সামরিক কায়দায় পতাকার প্রতি সালাম জানায়। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত সর্বস্তরের জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন। মুজিব বলেন, ‘বাংলার দাবির প্রশ্নে কোনো আপস নাই। বহু রক্ত দিয়েছি, প্রয়োজনবোধে আরও রক্ত দেবো, কিন্তু মুক্তির লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাবই। বাংলার মানুষকে আর পরাধীন করে রাখা যাবে না। আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। কিন্তু যদি তা সম্ভব না হয়, সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকার লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম আমাদের চলবে। এই সংগ্রামের পন্থা কী হবে তা আমিই ঠিক করে দেবো, সে ভার আমার উপরই ছেড়ে দিন। শাসক-কায়েমি স্বার্থবাদীদের কীভাবে পর্যুদস্ত করতে হয় আমি জানি। অতুলনীয় ঐক্য, নজিরবিহীন সংগ্রামী চেতনা আর প্রশংসনীয় শৃঙ্খলা বোধের পরিচয় দিয়া বাংলার মানুষ প্রমাণ করেছে, শক্তির জোরে তাদের আর দাবাইয়া রাখা যাবে না। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, যতদিন সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হবে, যতদিন একজন বাঙালি বেঁচে থাকবে, এই সংগ্রাম আমাদের চলবে। মনে রাখবেন, সর্বাপেক্ষা কম রক্তপাতের মাধ্যমে যিনি চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন, তিনিই সেরা সিপাহশালার। তাই বাংলার জনগণের প্রতি আমার নির্দেশ, সংগ্রাম চালিয়ে যান, শৃঙ্খলা বজায় রাখুন, সংগ্রামের কর্মপন্থা নির্ধারণের ভার আমার উপরই ছেড়ে দিন।’ এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে মুজিবের নির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে ২ জনের উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে দুপুর ১২টা ও সন্ধ্যা ৬টায় মোট ৩ ঘণ্টা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মুজিবের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কামাল হোসেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পক্ষে ছিলেন বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা এমএম ইয়াকুব খান, পাকিস্তান প্লানিং কমিশনের চেয়ারম্যান এমএম আহমদ। ২৩ মার্চ দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় ‘আজ প্রতিরোধ দিবস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আজ ২৩শে মার্চ বাংলাদেশে প্রতিরোধ দিবস হিসাবে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়াও অন্যান্য সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন নামে এই দিবসের পৃথক কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।’ ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘আজ ২৩শে মার্চ’ শীর্ষক শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আজ (মঙ্গলবার) ২৩শে মার্চ লাহোর প্রস্তাব দিবস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দিন ছুটি ঘোষণা করিয়াছেন। স্বাধীন বাংলা দেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, জাতীয় শ্রমিক লীগ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এই দিবসটি ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসাবে পালন করার আহ্বান জানাইয়াছেন।’ প্রতিবেদনে এদিনের বিস্তারিত কর্মসূচিও তুলে ধরা হয়েছিল। ২৩ মার্চ ঢাকা টেলিভিশনে পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান থাকলেও ঢাকা টেলিভিশনের বাঙালি কর্মীরা পাকিস্তান দিবসের কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করতে দেননি। পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের বদলে এদিন প্রচারিত হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা। পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার বদলে পর্দায় ভেসে উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আগেই পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছিল, যদি পাকিস্তানের পতাকা টেলিভিশনে প্রদর্শন না করা হয় তবে বাঙালি কর্মীদের টেলিভিশন কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেয়া হবে। কিন্তু পিছু হটেননি ঢাকা টেলিভিশনের বাঙালি কর্মীরা। টেলিভিশনে এদিন সম্প্রচারিত হয় কবিতার অনুষ্ঠান। সম্প্রচারিত হয়েছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে রচিত আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাটক ‘আবার আসিব ফিরে’। বাংলার মুক্তি ও স্বাধিকার আন্দোলনের রক্তঝরা পটভূমিকায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ও স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের ডাকে গতকালের দিনটি বাংলা দেশব্যাপী ’প্রতিরোধ দিবস’ হিসাবে পালিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি ভবনসমূহে, বাড়িঘরে, যানবাহনে কালো পতাকার পাশাপাশি গতকাল সংগ্রাম পরিষদ পরিকল্পিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডয়ন করা হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় বীর বাঙালির অগণিত মিছিল শুধু কামনা-বাসনা ও আকাঙ্ক্ষার ধ্বনিকে প্রতিধ্বনিত করে গেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত