ঢাকা শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

চোখ বেঁধে গুজরাট থেকে সুন্দরবনে পুশব্যাক নির্যাতনের অভিযোগ

মেহেরপুর সীমান্তে বিজিবি বিএসএফের সতর্কতা জারি
চোখ বেঁধে গুজরাট থেকে সুন্দরবনে পুশব্যাক নির্যাতনের অভিযোগ

সুন্দরবনের নদীপথে ৭৮ বাংলাদেশি নাগরিককে পুশব্যাক করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও ভারতীয় নৌবাহিনী। পরে গত রোববার রাত ১১টার দিকে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড তাদের সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায় হস্তান্তর করে।

অভিযোগ রয়েছে ভুক্তভোগীদের ভারতের গুজরাট থেকে চোখ বেঁধে এনে সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। হস্তান্তরকৃতদের মধ্যে ৭৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক এবং বাকি তিনজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হলেও ভারতের গুজরাটে তাদের জন্ম। বর্তমানে ৭৫ জনকে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে এবং বাকি তিনজনকে শ্যামনগর থানায় রাখা হয়েছে।

এদিকে শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাতেই তাদের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। জানা গেছে, হস্তান্তরকৃতদের অধিকাংশের বাড়ি নড়াইল, খুলনা ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলায়। বস্তি গুঁড়িয়ে, চোখ বেঁধে জাহাজে তুলে দেওয়া হয় তাদের।

পুশব্যাক করা একাধিক ব্যক্তি জানান, তারা সবাই ভারতের গুজরাট রাজ্যের সুরাট শহরের একটি বস্তিতে ছোটখাটো কাজ করে জীবন চালাতেন। গত ২৬ এপ্রিল স্থানীয় প্রশাসন তাদের বস্তি গুঁড়িয়ে দেয় এবং রাতেই সবাইকে আটক করে।

তাদের দাবি, ওই রাতেই হাত ও চোখ বেঁধে পুলিশ ক্যাম্পে নেওয়া হয় এবং সেখানে চার দিন আটকে রাখা হয়। পরে বিমানে করে তাদের কলকাতায়, সেখান থেকে জাহাজে করে সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় নিয়ে আসা হয়। তখনও চোখ বাঁধা ছিল। একপর্যায়ে সেখানে ছেড়ে দেওয়া হয়।

অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ: ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ২৬ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত আটকের পুরো সময়জুড়ে তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়। ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না, প্রায়শই মারধর ও গালাগাল করা হতো। তাদের অভিযোগ অনুযায়ী, কোনোরকম মানবাধিকার লঙ্ঘন ছাড়াই তাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিনজন জানান, তাদের বাবা-মা বাংলাদেশি হলেও তারা গুজরাটে জন্মগ্রহণ করেছেন। সে কারণে তারা জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক ছিলেন এবং বৈধ কাগজপত্রও ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে ভারত সরকার তাদের সব পরিচয়পত্র বাতিল করে নেয় বলে অভিযোগ করেন তারা।

প্রশাসনের তদারকি অব্যাহত: স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মানবিক সহায়তা অব্যাহত থাকবে।

কালীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিথুন সরকার জানান, গতকাল সোমবার সকালে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এদিকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলার সীমান্তে চলাচল ও কৃষিকাজে সতর্কতা জারি করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। একইভাবে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডও (বিজিবি) সন্ধ্যার পর থেকে সীমান্ত এলাকায় চলাচল সীমিত রাখতে বলেছে। সেইসঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সীমান্ত এলাকায় টহল জোরদার করা হয়েছে। এতে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।

সরেজমিন সীমান্ত এলাকায় গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নোম্যান্স ল্যান্ডে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশেরই জমি রয়েছে। কাঁটাতারের বেড়ার এপারে অনেক জমি রয়েছে ভারতীয়দের। তারা নানা জটিলতার কারণে চাষাবাদ করতে আসেন না। বাংলাদেশিদের বর্গা দেন।

দীর্ঘদিন এ বর্গা প্রথা চলে এলেও কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু পাক-ভারত যুদ্ধের দামামার কারণে গুপ্ত হামলার আশঙ্কায় ভারতীয় বিএসএফ ওই জমির চাষাবাদ ছাড়া অপ্রয়োজনে সীমান্ত এলাকায় চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মাইকিং করেছে।

সীমান্তবাসীদের মতে, সীমান্তে নোম্যান্স ল্যান্ডে ভারত অংশের কাঁটাতারের বেড়ার এপারে ১৫০ মিটারের মধ্যে ভারতীয় কৃষকের অন্তত দেড় হাজার থেকে দুই হাজার বিঘা জমি রয়েছে। যার সিংহভাগই বাংলাদেশি কৃষক বর্গা নিয়ে আবাদ করেন।

বিঘাপ্রতি ৮-১০ হাজার টাকা লিজ বা বর্গা খরচ দিতে হয়। এবছরও সবাই ওই জমি আবাদ করেছেন। আর কয়েকদিন পর ফসল ঘরে তুলবেন তারা। কিন্তু সীমান্তে সতর্কতাস্বরূপ বিএসএফ-বিজিবি অপ্রয়োজনীয় চলাচল ছাড়াও বিকাল থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মাইকিং করেছে।

সীমান্তবাসী আরও জানান, বাংলাদেশ সীমান্তের মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী মুজিবনগর, গাংনী ও মেহেরপুর সদর উপজেলা। সীমান্তের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৯ কিলোমিটার। এই সীমান্তটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে সংযুক্ত। এর সঙ্গে সংযুক্ত এলাকা হিসেবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নবীননগর, শিকারপুর, তাজপুর, ভাদুপাড়া, নবচন্দ্রপুর, লালবাজার, করিমপুরসহ অনেকগুলো গ্রাম। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে দুই দেশের বাসিন্দাদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্কও রয়েছে। সীমান্তবর্তী কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে ৭৪টি সীমান্ত গেট রয়েছে। যেগুলো দিয়ে ভারতীয় কৃষক কৃষিকাজ করতে কাঁটাতারের এপারে নিজ জমিতে আসেন। তারা এখন আসছেন বিএসএফের প্রহরায়।

সবচেয়ে বেশি জমি রয়েছে মেহেরপুরের ইচাখালী সীমান্তে। অন্তত ২৫-৩০ জন চাষির প্রায় ৭৫ বিঘা জমি রয়েছে সেখানে। এসব জমির মালিকদের বেশিরভাগই গোভিপুরের। এই জমিগুলোর মালিকানা নিয়ে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হলেও এখনও কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। এসব জমি দেশভাগের সময় ভারতের অংশে চলে যায়। তবে বাংলাদেশি কৃষকরা সেগুলো বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে আসছেন।

মেহেরপুর সদর উপজেলার গোভিপুর গ্রামের আসাদুল হক জানান, দেশভাগের পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছে।

নোম্যান্স ল্যান্ডে উভয় দেশের কৃষক কাজ করে। এখনও সবাই ফসল কেটে ঘরে তুলছেন। কোনো বাধা নেই। তবে পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে উভয় দেশের চাষিদের চলাচলের উপর সতর্কতা জারি করেছে। বিভিন্ন মসজিদের মাইকে ছাড়াও স্থানীয়ভাবে সন্ধ্যার পর থেকে চলাচলে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়। একই কথা জানান ইছাখালি গ্রামের আরশেদ হোসেন।

মেহেরপুর গাংনীর সীমান্তবর্তী তেতুঁলবাড়িয়া ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুল ওয়াহাব জানান, পাক-ভারত যুদ্ধের প্রভাব এখানে নেই।

আগের মতোই দুই দেশের চাষিরা চাষাবাদ করছেন। তবে সতর্কতাস্বরূপ উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সতর্কতা জারি করেছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত চলাচল সম্পূর্ণ সীমিত করা হয়েছে।

৪৭ বিজিবির কমান্ডিং অফিসার মাহাবুব মুর্শেদ জানান, সীমান্ত এলাকায় সতর্কতা জারি করে মাইকিং করা হয়েছে। বিকাল থেকে সবারই চলাচল সীমিত। এলাকায় টহল জোরদার করা হয়েছে। দুই দেশের যৌথ টহলও চলমান। তবে পাক-ভারত যুদ্ধের প্রভাব এ সীমান্তে নেই বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত