পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ও অন্য নেতাদের পছন্দে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ১৩৫ আইনজীবীকে সাড়ে ৯ মাসেও পরিবর্তন করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত-অনুসন্ধানে সাফল্য থাকলেও মামলা ট্রায়ালের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে দুদক। মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া আইনজীবীদের বিরুদ্ধে শৈথিল্য মনোভাবের অভিযোগ উঠেছে, দুদক কর্মকর্তাদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকেও।
দুদকের মামলা পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত উপ-পরিচালক এবং সহকারী পরিচালক পদের কর্মকর্তারা এসব আইনজীবীদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার মৌখিক অভিযোগ করেছেন ঊর্ধ্বতনদের কাছে। সরকার পরিবর্তনের সাড়ে ৯ মাসেও পরিবর্তন করা হয়নি পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া দুদক আইনজীবীদের। ফলে এই সময়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রুজু, গ্রেপ্তার, হাজার হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক, অবরুদ্ধ আদেশ পাওয়ার পরও এসব আইনজীবীর অসহযোগিতামূলক আচরণের কারণে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করার গতি পাচ্ছে না। দুদক উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম জানান, দুদকের প্যানেল আইনজীবী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রচার ও লিগ্যাল উইং কাজ করছে। আশা করা যায়, অতি দ্রুত দুদকের মামলা পরিচালনায় সহায়তার জন্য প্যানেল ল’ইয়ার নিয়োগ দেওয়া হবে।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরিচালক ও তিনজন উপ-পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা জানান, উচ্চ আদালতসহ সারা দেশের আদালতগুলোতে দুদকের মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগকৃত ১৩৫ জন আইনজীবীর মধ্যে ৫ আগস্টের পর নিজ থেকে পদত্যাগ করেছেন মাত্র ৩-৪ জন। কর্মকর্তারা আরও বলেন, প্রধান প্যানেল ল’ইয়ার খোরশেদ আলম খান দীর্ঘদিন আদালতেই আসছেন না। মোশাররফ হোসেন কাজলসহ অধিকাংশ আইনজীবী আদালতে অনুপস্থিত কিংবা অনিয়মিত থাকায় মামলা সংক্রান্ত কাজে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। আওয়ামী আইনজীবী ফোরাম কিংবা দলটির সঙ্গে সরাসরি জড়িতরা ৫ আগস্টের পর গাঢাকা দিয়েছেন।
দুদক জানিয়েছে, উচ্চ আদালতে মামলা পরিচালনার জন্য প্রধান আইনজীবী হিসেবে আছেন খোরশেদ আলম খান। তার সঙ্গে রয়েছেন আরও ১৫ আইনজীবী। খোরশেদ আলম খান নিয়োগ পাওয়ার আগে এই পদে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী (বর্তমানে হত্যা মামলাসহ দুর্নীতি ও জ্ঞাত বহির্ভূত মামলায় কারাগারে) আনিসুল হক। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে দুদকের নানা ফরমায়েশি মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন। অন্যদিকে, তার বিশ্বস্ত মোশাররফ হোসেন কাজল ঢাকার বিশেষ জজ কোর্টে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় অশোভন উক্তি ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছিলেন তিনি।
আর খোরশেদ আলম খান হাইকোর্টে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের রায়ের সাজার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদনসহ নানা আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন। ওই মামলায় বেগম খালেদা জিয়া সাজা খাটলেও শেষ পর্যন্ত গত ১৫ জানুয়ারি তিনিসহ অন্য আসামিরা খালাস পান।
দুদক কর্মকর্তাদের মতে, গণরোষে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত সাড়ে ৯ মাসে দুদক মামলার তদন্ত ও অনুসন্ধানে সর্বোচ্চ সাফল্য দেখিয়েছে। এই সময়ে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, ব্যাংক বিমা লুটেরা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ ও তাদের কয়েক হাজার সুবিধাভোগি দোসরের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখিয়ে অভিযান পরিচলানা ও মামলা রুজু করা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী মনোভাবাপন্ন দুদক আইনজীবীদের কারণে মামলার বিচারকাজ তরান্বিত হচ্ছে না। তারা বিভিন্ন অজুহাতে আদালতে অনুপস্থিত থেকে সময়ক্ষেপণ করছে। মামলার সাক্ষিরা নির্ধারিত দিনে আদালতে হাজির হলেও আইনজীবীদের ছলচাতুরিপনায় সাক্ষি না দিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। এতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, সাক্ষিসহ সংশ্লিষ্টদের হয়রানির সম্মুখিন হতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক উপ-পরিচালক বাসসকে জানান, আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ করা দুদক আইনজীবীদের বাদ দিয়ে নতুন করে আইন কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করছে কমিশন। খুব দ্রুত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
দুদক জানিয়েছে, ঢাকায় ১৩টি আদালতে এবং ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলায় দুদকের মামলা রুজু ও পরিচালনার জন্য আদালত রয়েছে। রাজধানীরগুলো হলো, বিশেষ জজ আদালত-১ থেকে বিশেষ জজ আদালত-১০ পর্যন্ত ১০টি, মহানগর দায়রা জজ আদালত, বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালত এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালত। ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলায় জেলা ও দায়রা জজ আদালত পদাধিকার বলে সিনিয়র স্পেশাল জজ হিসেবে দুদকের মামলা পরিচালনা করে থাকে।
দুদকের জেলা ও সমন্বিত জেলা কার্যালয় রয়েছে ৩৬টি আর বিভাগীয় কার্যালয় ৮টি। প্রধান কার্যালয়ে অপারেশন উইংয়ের তত্ত্বাবধানে বিশেষ শাখা, মানি লন্ডারিং শাখা, তদন্ত-১ ও তদন্ত-২ রয়েছে। এসব দপ্তর বিভাগের মামলা তদন্ত, অনুসন্ধান, মামলা রুজু ও চার্জশিট দিয়ে থাকে। কিন্তু আইনজীবীদের অসহযোগিতামূলক আচরণের কারণে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী দায়ের করা মামলাগুলোর আইনি গতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তরা।
দলের প্রতি অনুগত ও আওয়ামী লীগ নেতাদের আস্থাভাজন আইনজীবীরা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের উচ্চ আদালতসহ বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে আদালতসমূহে দুদকের মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ পেয়েছিল। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পতনের পর দুদক দুর্নীতি দমনে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়াই মামলার তদন্ত, অনুসন্ধান, চার্জশিট দাখিল, আসামি গ্রেপ্তার এবং মামলার বিচার প্রক্রিয়া তরান্বিত করার পদক্ষেপ নেয় কমিশন। কিন্তু আদালতে দুদক আইনজীবীদের অনুপস্থিতি, অনাগ্রহ ও ঢিমেতালে মনোভাবের কারণে কিছুটা স্থবির হয়ে পড়েছে মামলাগুলোর কার্যক্রম। দুদক তাদের কাছ থেকে কোনো কার্যকর পরামর্শও পাচ্ছে না। ফলে গত সাড়ে ৯ মাসে আদালতে পলাতক আওয়ামি লীগ ও তাদের দোসরদের শত শত কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সন্ধান, অনুসন্ধান, ক্রোক ও গ্রেপ্তার আসামিদের বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করছেন আওয়ামী লীগের অনুগত এসব আইনজীবী।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সেক্রেটারি ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস বলেন, জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট দুদক বুঝতে সক্ষম না হলে তা হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এই বিপ্লবে যারা শহিদ হয়েছেন তারা এদেশে আওয়ামী লীগের লুটতরাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। সাড়ে ৯ মাসেও কমিশনের আওয়ামী লীগের অনুগত আইনজীবীদের পরিবর্তন করা হয়নি, এটা দুঃখজনক। পতিত স্বৈরাচার ও তাদের দোসরদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে দুদক প্রতিষ্ঠান হিসাবে তার মর্যাদা হারাবে।
অবিলম্বে আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া দুদক আইনজীবীদের পরিবর্তন করে জুলাই স্পিরিটের সঙ্গে সম্পৃক্ত আইনজীবীদের নিয়োগ দিতে দুদকের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল হাসান সজল বলেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী রাষ্ট্র পুর্নগঠনের সময় দুদক পিছিয়ে পড়বে, তা কাম্য নয়। সাড়ে ৯ মাস পেরিয়ে গেছে, এখনও দুদকে তাদের প্যানেল ল’ইয়ার পরিবর্তন করতে পারেনি। এটি ফ্যাসিস্ট ও তাদের দোসরদের সহযোগিতা ও মামলার দীর্ঘসূত্রিতার শামিল।
তিনি আরও বলেন, ‘সর্ষের ভেতর ভূত’ থাকলে দুর্নীতি দমন হবে না। দুদক প্যানেল ল’ইয়ার নিয়োগের জন্য দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে যে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে, তাতে দক্ষ ও যোগ্য আইনজীবী পাওয়া যাবে না। তবুও বলব, অবিলম্বে দুদকে আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে মামলাগুলোর ট্রায়াল (বিচার প্রক্রিয়া) করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।