
নারায়ণগঞ্জে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণ যেন নিত্যদিনের আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। গত তিন মাসেই অন্তত সাতটি ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন ২০ জন, প্রাণ গেছে ৯ জনের।
সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে ২১ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জে। গ্যাস বিষ্ফোরণে একই পরিবারের নয়জন দগ্ধ হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে একে একে নিভে যায় ৭টি জীবনের প্রদীপ। ২৪ আগস্ট মারা যায় এক মাসের শিশু ইমাম উদ্দিন। পরদিন শিশুটির নানি তাহেরা আক্তার (৫০)। ২৮ আগস্ট হাসান গাজী ও তার মেয়ে জান্নাত, ২৯ আগস্ট সালমা ও আসমার মেয়ে তিসা। গত শুক্রবার রাতে মারা যান আসমা নিজেও। এ ঘটনায় বেঁচে থাকা আরও দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
শুধু সিদ্ধিরগঞ্জ নয়, শহরের অন্য অংশেও একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। ২৮ আগস্ট রাতে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অ্যাম্বুলেন্সে হঠাৎ ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। সিএনজি সিলিন্ডার থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই। আতঙ্কে চারপাশে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। দগ্ধ হন অ্যাম্বুলেন্স চালক ও এক পথচারী।
স্থানীয়দের মতে, তীব্র গরমে এমন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। গরমে বিদ্যুৎচাপ ওঠানামা করে, ফলে ফ্রিজ বা এসির কম্প্রেসারে চাপ বাড়ে। ছোট্ট যান্ত্রিক ত্রুটিই পরিণত হয় প্রাণঘাতী বিস্ফোরণে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, জুন থেকে আগস্ট মাত্র তিন মাসেই নারায়ণগঞ্জে অন্তত সাতটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তিনটি ফ্রিজ কম্প্রেসার বিস্ফোরণ, দুটি এসি বিস্ফোরণ এবং দুটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। এসব ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন অন্তত ২০ জন, এরমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৯ জন।
একটির পর একটি দুর্ঘটনা ঘটলেও কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এখনও নেওয়া হয় নি। ফ্রিজ ও এসির যন্ত্রাংশের গুণগত মান, গ্যাস সিলিন্ডারের সঠিক ব্যবহার এবং পুরনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত সার্ভিসিং ও যন্ত্রাংশের মান নিশ্চিত করা না গেলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঠেকানো সম্ভব নয়।
ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, বিছানাজুড়ে শুয়ে আছেন দগ্ধ রোগীরা। ৩২ বছর বয়সী রুবিনা আক্তার এখনও ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেননি। গত জুলাইয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে তাদের বাসায় ফ্রিজের কম্প্রেসার বিস্ফোরণে তিনি ও তার ৫ বছরের ছেলে দগ্ধ হন।
রুবিনা বলেন, ফ্রিজটা পুরনো ছিল, কিন্তু ভাবিনি এভাবে বিস্ফোরিত হবে। আগুনে আমার ছেলের শরীরের অনেকটা পুড়ে গেছে। আজও রাতে ঘুমাতে পারি না।
একই চিত্র দেখা গেছে ফতুল্লার একটি পরিবারে। এসির কম্প্রেসার বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন দম্পতি। স্বজনরা বলছেন, গরমে এসি সারারাত চলছিল। হঠাৎ রাত তিনটার দিকে ভয়ঙ্কর শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তে পুরো ঘর ধোঁয়ায় ঢেকে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রীষ্মকালে এসব দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. আশরাফুল হক এর মতে, ‘ফ্রিজ বা এসির কম্প্রেসার গরমে সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে থাকে। বিদ্যুৎ ভোল্টেজ ওঠানামা করলে মোটরের কয়েল অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। যদি যন্ত্রাংশ পুরনো হয় বা ত্রুটি থাকে, তাহলে তা বিস্ফোরিত হতে পারে। অ সময় গ্যাস লিক হয়ে আগুন ধরে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সিলিন্ডারের ক্ষেত্রেও একই বিষয়। অতিরিক্ত গরমে সিলিন্ডারের গ্যাস প্রসারিত হয়। যদি নিরাপত্তা ভাল্ব কাজ না করে, তাহলে বিস্ফোরণ ঘটে।’
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল আরেফিন জানান, গত এক মাসেই তারা অন্তত পাঁচটি গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটনায় উদ্ধার অভিযান চালিয়েছেন। মানুষ এখনও সচেতন নয়। পুরনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে, নিয়মিত সার্ভিসিং করে না। অনেকেই ঘরের ভেতরে ফ্রিজ বা এসি এমনভাবে রাখেন, যেখানে বাতাস চলাচল হয় না। এতে যন্ত্র অতিরিক্ত গরম হয় এবং বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়ে।
নারায়ণগঞ্জের তল্লা এলাকার বাসিন্দা নূর আলম গত বছর স্ত্রীকে হারিয়েছেন ফ্রিজ বিস্ফোরণে। তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। সেদিন রাতে হঠাৎ বিস্ফোরণে পুরো ঘর আগুনে ভরে যায়। আমি কোনোভাবে বের হতে পারলেও স্ত্রী আটকা পড়ে যায়। আজও মনে হয়, যদি আগে বুঝতাম ফ্রিজটা সমস্যা করছে, তাহলে হয়তো এ দুর্ঘটনা ঘটত না।
এমন ঘটনা বারবার ঘটায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। চাষাঢ়া এলাকার গৃহিণী শবনম আক্তার বলেন, এখন রাতে ফ্রিজের প্লাগ খুলে রাখি। ভয় হয়, কখন কী ঘটে যায়।
প্রতিটি দুর্ঘটনার পর আহতদের স্রোত ঢাকার হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। চিকিৎসকরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরে দগ্ধ রোগীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ডা. ফারহানা হক জানান, আগে দগ্ধ রোগীদের বড় অংশ আসতো গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে। এখন নতুন করে ফ্রিজ ও এসি বিস্ফোরণে দগ্ধ রোগী আসছে। এগুলো প্রতিরোধযোগ্য দুর্ঘটনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতা ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণই একমাত্র সমাধান। পুরনো ফ্রিজ বা এসি দীর্ঘদিন ব্যবহার না করে নিয়মিত সার্ভিসিং করা দরকার। ভোল্টেজ ওঠানামা রোধে স্ট্যাবিলাইজার ব্যবহার করা উচিত।
ফ্রিজ, এসি বা সিলিন্ডার যন্ত্র সবসময় বাতাস চলাচল করে এমন জায়গায় রাখা দরকার। গরমকালে সিলিন্ডার কখনই রোদে রাখা উচিত নয়। যন্ত্র থেকে হালকা গ্যাসের গন্ধ পেলে দ্রুত মিস্ত্রি ডেকে পরীক্ষা করাতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, প্রতিটি এলাকায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ক্যাম্পেইন চালানো জরুরি। স্কুল-কলেজেও সচেতনতামূলক ক্লাস চালু করা যেতে পারে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) এরইমধ্যে একটি জরুরি বৈঠক করেছে। প্রশাসক এএইচএম কামরুজ্জামান বলেন, আমরা ফায়ার সার্ভিস ও বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে সচেতনতা কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। প্রতিটি ওয়ার্ডে লিফলেট বিতরণ করা হবে। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রত্যাশা দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হোক। চাষাঢ়ার ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির বলেন, প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই বিস্ফোরণের খবর। এখন মনে হয় ঘরে ফ্রিজ রাখা মানেই ঝুঁকি। অথচ এসব ঘটনা সচেতন হলে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
নারায়ণগঞ্জের প্রবীণ সমাজকর্মী আবদুল মতিন বলেন, জীবন বাঁচানো এখন সবচেয়ে জরুরি। প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ বিভাগ সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। মানুষকেও সচেতন হতে হবে।
গ্যাস বিস্ফোরণ এখন আর ব্যতিক্রমী দুর্ঘটনা নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনের শঙ্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তীব্র গরমে যন্ত্রপাতির ওপর বাড়তি চাপ ও অযত্নে রাখা যন্ত্রই এ দুর্ঘটনার মূল কারণ। সচেতনতা বাড়ানো, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রশাসনিক নজরদারি ছাড়া এ বিপদ ঠেকানো যাবে না।