ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইরানের ঐতিহ্যবাহী শহর

ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ইরান। যেখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মসজিদণ্ডমাদ্রাসা। জন্ম নিয়েছেন অনেক মুসলিম মনীষী। যদিও বর্তমান ও প্রাচীন ইরানের মধ্যে অনেক পার্থক্য। বদলে গেছে প্রাচীন ইরানের ভৌগলিক অবস্থান। জন্ম নিয়েছে অনেক শহর। ইরানে মুসলিম সভ্যতার বিখ্যাত কয়েকটি শহর নিয়ে লিখেছেন- আবদুল্লাহ আফফান
ইরানের ঐতিহ্যবাহী শহর

ইসফাহান : রাজধানী তেহরানের ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ইসফাহান। ভৌগলিকভাবে ইসফাহান জাগ্রোস পর্বতমালার পাদদেশে জায়েন্দে নদীর তীরে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫৯০ মিটার ওপরে এর অবস্থান। এটি ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী। একসময় ইসফাহান বিশ্বের বড় শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। ১০৫০ থেকে ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল এর সমৃদ্ধিকাল। অনন্য ইসলামি স্থাপত্য, ছাদ ঢাকা সেতু, মসজিদ ও মিনারের অসাধারণ সৌন্দর্য আজও ইসফাহানকে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে রেখেছে। ইসফাহানের সৌন্দর্য কিংবদন্তিতুল্য। ইরানে প্রবাদ প্রচলিত আছে, ইসফাহান পৃথিবীর অর্ধেক। প্রাচীন ইসফাহান এলামীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। মেদিয়ান গোত্রের অধীনে শহরটির নাম ছিল আসপানদানা। ম্যাসেডোনীয় দখল থেকে আর্সাসিডরা ইরানকে মুক্ত করার পর এটি পার্থীয় সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। সাসানিদ যুগে ইসফাহান শাসন করতেন ‘ইসফুরান’ বা সাতটি অভিজাত পরিবারের সদস্যরা। এ সময় ইসফাহান সামরিক দিক দিয়ে বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আরবদের কাছে ইরানিদের সর্বশেষ পরাজয়ের পর ইসফাহান আরবদের পদানত হয়। সেলজুক বংশের মালিক শাহের শাসনামলে ইসফাহান পুনরায় রাজধানীর মর্যাদা পায়। এ সময়টা ছিল ইসফাহানের স্বর্ণযুগ। চিকিৎসক ও দার্শনিক ইবনে সিনা ১১০০ শতকে ইসফাহানে শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে ইসফাহান জায়নামাজ, শতরঞ্জি ও গালিচা, বস্ত্র, ইস্পাত এবং বিবিধ হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত। এখানে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনের চুল্লি রয়েছে। ইসফাহানের অনুকূল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গড়ে উঠেছে দুই হাজারেরও বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ইরানের বড় খনিজ তেল শোধনাগার এবং গুরুত্বপূর্ণ বিমানঘাঁটি এখানে অবস্থিত। ইরানের সবচয়ে উন্নত উড়োজাহাজ তৈরির কারখানাও এখানে। রয়েছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও।

তাবরিজ : ইরানের উত্তর-পশ্চিমকোণে অবস্থিত তাবরিজ। এটি প্রশাসনিকভাবে দেশটির পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী। ভৌগোলিকভাবে শহরটি উর্মিয়া হ্রদের ৬০ কিলোমিটার পূর্বে, সমুদ্র সমতল থেকে ১৩৫০ থেকে ১৬০০ মিটার উচ্চতায়, তিনদিকে পর্বতবেষ্টিত একটি অঞ্চলে, কুরি নদীর উপত্যকায় অবস্থিত। শহরের পশ্চিমভাগ একটি সমভূমিতে উন্মুক্ত। যেটি ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে উর্মিয়া হ্রদের তীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। নগরীটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত; যাতে ঘন ঘন ও তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। বেশ কয়েকবার ভূমিকম্পের কারণে তাবরিজ শহরটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রতিবারই ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীকে পুনর্র্নিমাণ করা হয়। ১৩০০ শতকের শেষে এসে তাবরিজ মঙ্গোল রাজবংশ ইল-খানের শাসক মাহমুদ গাজান ও তার উত্তরসূরীর রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৪০০ শতকের শেষে ১৩৯২ সালে তুর্কি দিগি¦জয়ী তৈমুর লং শহরটি দখল করেন। এর কয়েক দশক পরে কারা কৈউনলু নামের তুর্কমেন জাতির লোকেরা তাবরিজকে তাদের রাজধানী বানায়। তুর্কমেনদের অধীনে নীল মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। তাবরিজ উত্তর-পশ্চিম ইরানের বৃহত্তম শিল্পোৎপাদন, বাণিজ্য ও পরিবহনকেন্দ্র। এখানে মূলত গালিচা, বস্ত্র, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পাদুকা, সিমেন্ট, কৃষিযন্ত্র, মোটরযান, খনিজ তেল পরিশোধন, খনিজ তেলজাত রাসায়নিক দ্রব্য, গৃহস্থালি বৈদ্যুতিক উপকরণ ও সাবান উৎপাদন করা হয়। শহরটি এর হস্তশিল্পের জন্য, বিশেষ করে হাতেবোনা মাদুর ও গহনার জন্য বিখ্যাত। তাবরিজের মিষ্টান্ন, চকলেট, শুকানো বাদাম ও ঐতিহ্যবাহী তাবরিজি রান্না সারা ইরানে উৎকৃষ্ট মানের খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। তাবরিজে বহুসংখ্যক ঐতিহাসিক ভবন ও স্থাপনা রয়েছে। যেগুলো ইরানের প্রাচীন ইতিহাস জুড়ে দেশটির স্থাপত্যের বিবর্তনের সাক্ষী। এতে রয়েছে ১৫০০ শতকে নির্মিত একটি সুদৃশ্য নীল রঙের টালির তৈরি মসজিদ। যার নাম মাসজিদণ্ডই কাবুদ। ১৪০০ শতকে একটি পুরাতন ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের স্থানে নির্মিত। নগর দুর্গটি তার সরল নকশা, আয়তন ও চমৎকার অবস্থায় সংরক্ষিত ইটের কাজের জন্য দর্শনীয়। আরও আছে ইরানের মঙ্গোল রাজবংশীয় শাসক মাহমুদ গাজানের ১২টি পার্শ্ববিশিষ্ট সমাধি। নতুন ভবনগুলোর মধ্যে রেলস্টেশন ও ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত তাবরিজ বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখ্য। ২০১৫ সালে বিশ্ব কারুকলা পরিষদ তাবরিজকে বিশ্ব গালিচা বয়ন নগরী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৮ সালে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা-ওআইসি এটিকে দৃষ্টান্তমূলক পর্যটক নগরী মর্যাদায় ভূষিত করে।

শিরাজ : শিরাজ ইরানের ষষ্ঠ জনবহুল শহর এবং ফর্স প্রদেশের রাজধানী। এটি ইরানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। এর মোট আয়তন ২৪০ বর্গকিলোমিটার। শিরাজ ইরানের একটি ঐতিহাসিক শহর; যা ইরানের এথেন্স নামেও পরিচিত। এখানে অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। যেমন- করিম খানের নগর দুর্গ, ভাকিল মসজিদ, হাফিজের সমাধি, নাসির ওল মোলক মসজিদ (গোলাপি মসজিদ), ইরাম গার্ডেন, শাহ চেরাঘের মাজার এবং সাদি-শিরাজির সমাধি।

মাশহাদ : উত্তরপূর্ব ইরানের একটি বড় শহর মাশহাদ। বর্তমানে প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের ওপর বিস্তৃত এ শহর রাজাভি খোরসান প্রদেশের রাজধানী ও ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। রাজধানী তেহরান থেকে ৮৫০ কিলোমিটার পূর্বদিকে কাশাফ নদীর তীরে শহরটি অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৯৮৫ মিটার। বিখ্যাত খলিফা হারুনুর রশিদের কবরস্থান এখানে অবস্থিত। মাশহাদ বিখ্যাত পার্শি কবি ও শাহনামা কাব্যগ্রন্থের লেখক ফেরদৌসির শহর হিসেবেও পরিচিত। রেলপথ, সড়কপথ ও বিমানপথে এ শহর রাজধানী তেহরানের সঙ্গে খুব ভালোভাবে যুক্ত। অর্থনৈতিকভাবেও এ শহর ইরানের অন্যতম বিকাশশীল অঞ্চল। বিশেষ করে, উল ও কার্পেট শিল্পের জন্য এ শহরের খ্যাতি রয়েছে। শহরটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত