বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। বাংলাদেশে আছে প্রায় ৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ গ্রন্থে বাংলাদেশের ৩ হাজার ৮১৩টি উদ্ভিদ প্রজাতির বর্ণনা রয়েছে। ধারণা করা হয়, আবাসস্থল ধ্বংস ও মনুষ্য সৃষ্টির কারণে বাংলাদেশে ৮ থেকে ১০ শতাংশ উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরণ ইউনিয়ন (আইইউসিএন) বাংলাদেশের ১ হাজার উদ্ভিদ প্রজাতির বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করে সেগুলোর স্ট্যাটাস প্রদান করেছে। বৃহৎ দুটি খণ্ডে বাংলাদেশের উদ্ভিদ লাল তালিকা প্রকাশ করেছে। সে মূল্যায়নে ২৭১ প্রজাতির উদ্ভিদকে ন্যূনতম উদ্বেগজনক প্রজাতি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ এসব প্রজাতির উদ্ভিদগুলো নিয়ে আপাতত আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। এগুলো এ দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে নেই। কিন্তু ৩৯৫ প্রজাতির উদ্ভিদকে সম্মিলিতভাবে বিলুপ্তির হুমকিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে মহাবিপন্ন ও ১২৭ প্রজাতি রয়েছে বিপন্ন অবস্থায়। এরই মধ্যে সাতটি প্রজাতির উদ্ভিদ এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এগুলো হলো- ফ্যাবেসি গোত্রের কুরা জিরি, ম্যাগনোলিয়েসি গোত্রের ম্যাগনোলিয়া, মিরিকেসি গোত্রের সুফি বা সাতসারিলা, মেলোস্টোমেটাসি গোত্রের গোলা অঞ্জন, পুত্রঞ্জীভেসি গোত্রের ড্রাইপেটিস ভেনাসটা ও মির্টেসি গোত্রের জামজাতীয় সিজাইজিয়াম ভেনাস্টাম।
উদ্ভিদ নিয়ে জরিপের পরিসংখ্যান : কিছু উদ্ভিদ সংরণে জরুরি পদপে না নিলে তা দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এমন পাঁচটি প্রজাতির উদ্ভিদ চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেগুলো হলো- বাঁশপাতা, বনখেজুর, বালবোরক্স, লম্বা ট্রায়াস অর্কিড ও বলগাছ। গবেষক ও বিজ্ঞানীরা সারা দেশে জরিপ চালিয়ে কয়েকটি স্থানে ওই গাছগুলো খুব অল্পসংখ্যক টিকে আছে বলে দেখতে পেয়েছেন। লাল তালিকা মূল্যায়নের ফলাফল অনুযায়ী, ১ হাজার উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে ৭টি বিলুপ্ত, ৫টি মহাবিপন্ন, ১২৭টি বিপন্ন, ২৬২টি সংকটাপন্ন, ৬৯টি প্রায় সংকটাপন্ন, ২৭১টি পরিবেশে ভালোমতো টিকে আছে এবং ২৫৮টি উদ্ভিদ প্রজাতির ব্যাপারে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। দেশের বেশির ভাগ উদ্ভিদ কোনো না কোনোভাবে আমাদের কাজে লাগে। এগুলো আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্যেরও অংশ। এর আগে নগরায়ণ ও কৃষিকাজ করতে গিয়ে আমরা অনেক ধরনের উদ্ভিদ এ দেশ থেকে হারিয়েছি। ফলে এ সংকটাপন্ন প্রজাতিগুলোকে রায় আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। আইইউসিএন বাংলাদেশের হিসেবে, বিশ্বে প্রায় পাঁচ লাখ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৯৫ হাজার উদ্ভিদকে শনাক্ত করেছে যুক্তরাজ্যে অবস্থিত সবচেয়ে বড় হারবেরিয়াম কিউ হারবেরিয়াম। উদ্ভিদের প্রজাতি সংরণবিষয়ক রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের হিসেবে, দেশে ২০১৯ সাল পর্যন্ত উদ্ভিদের প্রজাতি ছিল ৩ হাজার ৮৪০টি। যদিও পরে আরও ১০টি উদ্ভিদ প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়।
৩৯ শতাংশ উদ্ভিদই বিপদাপন্ন : বাংলাদেশের উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোর মধ্যে কোনটি কেমন অবস্থায় আছে, তা বোঝার জন্য করা লাল তালিকা বা রেড লিস্টে অনেক অবাক করা তথ্য উঠে এসেছে। এক হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের ওপর করা ওই জরিপে দেখা গেছে, এর ৩৯ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে বিপদগ্রস্ত আছে, অর্থাৎ বিপদাপন্ন। ওই জরিপের বাইরে দেশের আরও প্রায় তিন হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়ে গেছে, যেগুলোর ওপর জরিপ করা দরকার বলে মনে করছেন গবেষকেরা।
প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরণবিষয়ক সংস্থা আইইউসিএনের করা এ উদ্ভিদের লাল তালিকা প্রণয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশের চারজন জ্যেষ্ঠ উদ্ভিদবিজ্ঞানী। দেশে একাধিকবার প্রাণীদের লাল তালিকা তৈরি হলেও উদ্ভিদের তালিকা এই প্রথম তৈরি হলো। বিলুপ্তির তালিকায় নাম লেখানো অন্য প্রজাতিগুলো হচ্ছে- কুড়াজিরি, ভানু দেয়পাত, গোলা অঞ্জন, সাত সারিলা, থার্মা জাম ও মাইট্রাসিস। এ ছাড়া তালিপাম জাতের গাছ দেশের বনভূমিতে ছিল; কিন্তু এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য টিকে আছে। ফলে একেও প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বিলুপ্ত প্রজাতি রায় করণীয় : ম্যাগনোলিয়া গ্রিফিতি প্রজাতির গাছ এ বাংলারই গাছ। এ গাছের জন্মস্থান বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারত। বাংলাদেশ থেকে এ প্রজাতির গাছ হারিয়ে গেলেও জন্মস্থান বা পৃথিবীর অন্য কোথাও না কোথাও সে গাছ থাকতে পারে। ভারতের অরুণাচল প্রদেশের চ্যাংগল্যাং, তাওয়াং ও লোহিত জেলায় এ গাছ রয়েছে বলে জানা গেছে। সেসব দেশের উদ্ভিদবিদদের সহায়তায় বা দুই দেশের ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম যদি পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে সে গাছের অনুসন্ধান ও চারা উৎপাদন করতে সম্মত হয়, তাহলে সে চারা এ দেশে এনে এই প্রজাতিটি ফিরিয়ে আনা যায়। একইভাবে সেই প্রক্রিয়া অন্যান্য বিলুপ্ত প্রজাতি রার বেলাতেও হতে পারে। বিপন্নের তালিকায় থাকা প্রজাতির গাছগুলোকে রার এখনই মোম সময়। সেগুলো হারিয়ে যাওয়ার আগেই সেসব গাছ যেটি যেখানে আছে, সেটি আইনের মাধ্যমে সংরতি প্রজাতির গাছ হিসেবে সরকারকেই ইন সিটু পদ্ধতিতে সংরণের উদ্যোগ নিতে হবে। সেসব গাছ থেকে বীজ বা স্পোর সংগ্রহ করে চারা উৎপাদনের দ্বারা এক্স সিটু পদ্ধতিতে সেগুলো দেশের বিভিন্ন সংরতি এলাকা, উদ্যান, শিাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্থানে ছড়িয়ে দিতে হবে। বীজ ছাড়া কোনিং বা টিস্যু কালচারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্রজাতির উদ্ভিদকে রা করা যেতে পারে। তবে সেগুলো ছড়ানোর আগে সেসব প্রজাতির গাছপালা যেখানে যে পরিবেশে আছে, সে পরিবেশকেও রা করতে হবে। যে উদ্ভিদ প্রজাতির বীজ থেকে অঙ্কুর গজানো, ডালপালা মেলা, ফুল-ফল ও বীজ উৎপাদন করার জন্য যে ধরনের অনুকূল পরিবেশ লাগে, সেখানে সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভিদের ব্যাপকহারে বিপন্নের ঝুঁকির পেছনে অন্যতম প্রধান কারণই হলো তার আবাসস্থল ধ্বংস। লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনে পৃথিবীর উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোর বংশগত নমুনা সংরণের জন্য যেরূপ সংরণাগার করা হয়েছে, দেশেও তেমন বীজব্যাংক গড়ে তোলা যায়। কিউ যদি কোনো প্রজাতির উদ্ভিদের কৌলিকণা লাখ লাখ বছর ধরে সংরণ করতে পারে, তাহলে আমরা কেন শত শত বছরের জন্য পারব না? এর বড় সুবিধা হলো, যখনই কোনো উদ্ভিদ প্রজাতি চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছাবে, সে প্রজাতি তার বংশধর উৎপাদনে অম হবে, তখনই জার্মপ্লাজম ব্যাংক বা বীজব্যাংক থেকে বীজ অথবা স্পোর বের করে তার চারা তৈরির মাধ্যমে প্রজাতি রা করা হবে।
যথাযথ পদপে না নিলে যত শঙ্কা : এ দেশের বিপন্ন গাছগুলো সংরণের যথাযথ পদপে বা প্রকল্প না নিলে বিদ্যমান থাকা প্রজাতির গাছও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। একটি প্রজাতির বিলুপ্তি মানে শুধু সে গাছটিকেই হারিয়ে ফেলা নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা হারাচ্ছি সে প্রজাতির সঙ্গে অন্য যেসব জীবের সম্পর্ক রয়েছে, তাদেরও। গবেষকরা দেখেছেন, এ গ্রহের বুক থেকে যে কোনো একটি প্রজাতির গাছ হারিয়ে যাওয়া মানে তার ওপর নির্ভরশীল অন্তত ৩০ প্রজাতির জীবের জীবন হুমকির মধ্যে পড়া। একটি প্রজাতির গাছ হারিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো, সে উদ্ভিদের বিবর্তনের ইতিহাস মুছে ফেলা। আমরা সে গাছের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কিছু পাতা, ডাল বা শিকড়কে হারাই না, বরং তার সঙ্গে হারাই তার বংশগত কৌলিসম্পদ বা জিনগুলোকেও। একটি গাছের ভেতরে শুধু জাইলেমণ্ডফোয়েম বা কোষ-কলাই নয়, তার ভেতর যে জীবনের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, সে রহস্য আর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কখনও জানতেই পারবে না। বুঝবে না, সে প্রজাতির মধ্যে থাকা কোন প্রাণরাসায়নিক উপাদান মানুষের রোগ-চিকিৎসায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল! এমনকি গাছের নিজেরও রোগ প্রতিরোধে তার ভেতরে কী শক্তি লুকিয়েছিল! কাজেই পৃথিবীর বুকে জন্মানো কোনো প্রজাতির গাছকেই অবহেলা করা বা তুচ্ছ ভাবার কারণ নেই। সে প্রজাতির গাছের একটি জিনই বদলে দিতে পারে মানুষের স্বাস্থ্য ও খাদ্যের ভবিষ্যৎ। খুলে দিতে পারে উদ্ভিদ প্রজননের নতুন দিগন্ত।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী