প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহর ভয় ও সচেতনতা হলো- তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের সবচেয়ে মজবুত মাধ্যম ও তাঁর অনুগ্রহ লাভের সবচেয়ে বড় কারণ। এটাই সেই লাভজনক ব্যবসা, যাতে কোনো ক্ষতি নেই। এটাই সেই পাথেয় যা কখনো শেষ হয় না। এটাই সেই প্রকৃত আনন্দ, যা কখনও থামে না। এটাই হলো দুনিয়ার জীবনের আসল শান্তি, যা পরকালের চিরস্থায়ী শান্তির আগেই মানুষ পায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমিনরা, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে আল্লাহ তোমাদের ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন ও তোমাদের ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অতিশয় মঙ্গলময়।’ (সুরা আনফাল : ২৯)।
দিনগুলো যেভাবে দ্রুত চলে যাচ্ছে ও বছরগুলো যেভাবে অতিবাহিত হচ্ছে, তাতে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষা, বিবেকবানদের জন্য চিন্তা ও বুদ্ধিমানদের জন্য উপদেশ গ্রহণের সুযোগ বিস্তর রয়েছে। একজন মোমিন এসব উপলব্ধি করে চিন্তায় মগ্ন হয়, গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবতে থাকে ও তার ভবিষ্যতের সময়গুলোকে অতীতের সঙ্গে তুলনা করে। সে জানে, আজকের দিনও কাল অতীত হয়ে যাবে, আজকের কোলাহল এক সময় নিস্তব্ধ হয়ে যাবে। আজকের বছর অনেকটা আগের বছরের মতোই, আজকের দিন অনেকটা গতকালের মতোই। সময়ের ঘটনাগুলো যেন ঘূর্ণায়মান চাকার মতো ঘুরছে ও সময়ের স্থায়িত্ব যেন সকালের সূর্যোদয়ের মতো ক্ষণস্থায়ী হচ্ছে।
এটাই আল্লাহর সেই নির্ধারিত নিয়ম, যা তিনি তাঁর সৃষ্টি ও জগতের ওপর জারি করেছেন। এই পৃথিবীতে কোনো অবস্থাই স্থায়ী নয়, কোনো কিছুই চিরকাল থাকে না। জীবন তার আপন নিয়মে চলতে থাকে, লোকদের নিয়ে উত্থান-পতনে ঘুরতে থাকে- যতক্ষণ না এই জীবনের সফর শেষ হয়ে আল্লাহর সাক্ষাতে উপনীত হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যাবর্তন আমাদের দিকেই।’ (সুরা গাশিয়াহ : ২৫)। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন সুনিশ্চিত।’ (সুরা আলাক : ৮)।
আমরা যখন আমাদের হিজরি বছরকে বিদায় জানাই ও তার দিনগুলোকে বিদায় দিই, তখন নতুন বছরকে শুভকামনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাই। আমরা নতুন বছরের সূচনা করি আশাবাদ ও ইতিবাচক চিন্তা নিয়ে। আর পুরোনো বছরের দিনগুলোকে বিদায় জানাই, সেসব দিনের ভেতরে থাকা আমাদের ভালো নিয়ত, কথা ও কাজগুলোকে স্মরণ করে। আমরা যখন বিগত বছরকে বিদায় জানাই, তখন একটি মহিমান্বিত সময়কেও বিদায় জানাই- একটি কল্যাণের মৌসুম, যেখানে আল্লাহ মুসলিমদের প্রতি করুণাবশত ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত হজ পালনের সুযোগ দিয়েছিলেন। আর আমরা সামনে পেয়েছি আরেক কল্যাণময় মৌসুম- আল্লাহর মাস মুহাররম। এটি এমন এক মাস, যার পরপরই আসে আরও অনেক কল্যাণময় সময়। একটার পর একটা, ধারাবাহিকভাবে কল্যাণের সময়গুলো চলতে থাকে। এই মুহাররম সম্পর্কে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ।’ (মুসলিম : ২৬৪৫)। এ হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, রমজানের পর মহররম মাসের নফল রোজা সবচেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ, আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ নফল নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।
হে মোমিন ভাই ও বোনেরা, আল্লাহতায়ালা তোমাদের বিশেষ সৌভাগ্য দান করেছেন, তোমরা এমন পবিত্র ভূমিতে এসেছ, এমন সময়ে এসেছ, যা বরকতময় ও সম্মানিত। আর এখানকার শাসকরা এই পবিত্র ভূমিগুলোর দেখাশোনা ও হেফাজতের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। তারা আগতদের নিরাপত্তা, শান্তি ও ইবাদতের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। এই ভূমিগুলোতে রয়েছে নিরাপত্তা ও ঈমান, প্রশান্তি ও সুখ, আর রয়েছে শান্ত-স্নিগ্ধ ছায়া, যা মনের গভীরে প্রশান্তি আনে। অতএব, হে মুসলিম ভাই ও বোনেরা, হজ ও ওমরার জন্য আগতরা, তোমরা এসব মহান নেয়ামত ও বড় অনুগ্রহকে গভীরভাবে উপলব্ধি করো, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো ও তাঁর প্রশংসায় ব্যস্ত থাক। এই পবিত্র ভূমিগুলোর মাহাত্ম্য ও সম্মান হৃদয়ে ধারণ করো। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণে যত্নবান হও, আর এখানকার শাসকদের জন্য দোয়া করো- যেন আল্লাহ তাঁদের সঠিক সিদ্ধান্ত, সাহায্য ও দুনিয়া-আখেরাতে উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করেন। কবি বলেছেন-
‘এই ভূমিতে যারাই আসে,
তাদের দৃষ্টি আটকে যায়
সুবিচার, নিরাপত্তা ও প্রাচুর্যের দৃশ্য দেখে।
শত্রুরাও একথা স্বীকার করে নিয়েছে,
কারণ সত্য তো সেটাই- যা শত্রুরাও মানতে বাধ্য হয়।
ইতিহাসের পাতা ভরা রয়েছে এর অসংখ্য প্রমাণে,
যা গুনে শেষ করা অসম্ভব।’
হে পরম দয়ালু ও পরম সম্মানিত রব আল্লাহ, যারা মক্কা ও মদিনার সেবা, দেখাশোনা ও আগতদের যত্নে নিযুক্ত আছেন- তাদের উত্তম ও পূর্ণ প্রতিদান দাও, বিশেষ করে দুই পবিত্র হারামের খাদেম সৌদি বাদশাহ ও তাঁর যুবরাজকে- দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বোত্তম প্রতিদান দাও। হে আল্লাহ, তুমি তাদের তোমার হেফাজতে রাখ, তোমার তত্ত্বাবধানে তাদের ঘিরে রাখো ও তোমার রক্ষায় তাদের নিরাপদ রাখ। তুমি এই মদিনা শহরের আমিরকেও উত্তম ও পূর্ণ প্রতিদান দাও। তাঁকে এই শহর, এখানকার বাসিন্দা, অতিথি ও আগতদের জন্য কল্যাণের কাজে সফলতা দান করো। তুমি এই বরকতময় দেশ- সৌদি আরবকে তোমার হেফাজতে রাখো, ষড়যন্ত্রকারী ও ধূর্তদের চক্রান্ত থেকে তোমার তত্ত্বাবধানে নিরাপদ রাখ।
হে সর্বোচ্চ মর্যাদাবান ও পরম দয়ালু প্রতিপালক আল্লাহ, তুমি হাজীদের হজ ও তাদের সব নেক আমল কবুল করো, তাদের পাপ মাফ করে দাও এবং এমন সফলতায় তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে দাও যা কখন ব্যর্থ হবে না, সব জায়গার মুসলমানদের নেক আমল কবুল করো ও তাদের সুন্দর আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ করো।
(০২-০১-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ২৭-০৬-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন - আবদুল কাইয়ুম শেখ)