ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)

আমিনুল ইসলাম হুসাইনী
জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পুরোটা জীবনই মুমিনের জন্য ‘উসওয়াতুন হাসানাহ’ বা সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং সর্বশেষ নবী ও রাসুল। তাঁর মুহাম্মাদ নামের অর্থই হলো প্রশংসিত। আর প্রশংশিত হবেই না কেন? আল্লাহতায়ালা যে তাঁকে অসংখ্য গুণ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। নবুওয়াত লাভের পর যেমন তিনি পবিত্র, তেমনি নবুওয়াত পাওয়ার আগের জীবনেও তাঁর থেকে মন্দ কথা, অপছন্দীয় ব্যবহার প্রকাশ পায়নি। তাঁর আচরণে কখনও কেউ কষ্ট পায়নি। আতিথেয়তা, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা ও ওয়াদা পালনসহ অসংখ্য গুণে গুণান্বিত নবীজির জীবনপন্থা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি পথভ্রষ্ট নন, আর না তিনি সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। আর সে মনগড়া কথাও বলে না।’ (সুরা নাজম : ২-৩)।

নবীজি (সা.)-এর চারিত্রিক সুমহান আদর্শে মুগ্ধ হয়েই মানুষ দলে দলে মুসলমান হয়েছে। এখনও হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। নবীজির মর্যাদা সবার ওপরে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী আমি আপনার মর্যাদাকে সবার ঊর্ধে স্থান দিয়েছি।’ (সুরা ইনশিরাহ : ৪)।

আল্লাহতায়ালা নবীজিকে এতই মর্যাবান করেছেন যে, আরশ থেকে শুরু করে কোরআনের পাতায় পাতায় যেখানে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়েছে, সেখানে নবীজির নামও উচ্চারিত হয়েছে। ভেবেছেন? আমরা আমাদের কথার দৃঢ়তা বাড়াতে আল্লাহর নামে শপথ করি। আর আল্লাহ শপথ করেন মুহাম্মাদ (সা.)-এর নামে। আমাদের খোশ নসিব যে আমরা এমন নবীজির উম্মত হয়েছি। শুধু নবীজির নামই নয়, তিনি যে শহরে জন্ম নিয়েছেন, বেড়ে উঠেছেন, তাঁর সম্মানার্থে সেই শহরের নামেও শপথ করে বলেছেন, ‘আমি শপথ করছি এই নগরীর, আর আপনি এই নগরীরই অধিকারী।’ (সুরা বালাদ : ১-২)।

আল্লাহতায়ালা নবীজিকে সৃষ্টিজগতের ‘রহমত’ স্বরূপ পাঠিয়েছেন। আরবি ‘রহমত’ শব্দের বাংলা অর্থ হলো কৃপা, পর-দুঃখমোচন, অনুগ্রহ, অনুকম্পা, বদান্যতা বা দয়া। যে দয়ার কোনা সীমারেখা নেই।

যে দয়া অবারিত। সে দয়া মানুষ-অমানুষ, মুসলিমণ্ডঅমুসলিম, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, বৃক্ষলতা, পদার্থ, প্রকৃতি-পরিবেশ এবং জগৎ ও মহাজগৎ-নির্বিশেষে সবার জন্যই প্রযোজ্য। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতএব, আল্লাহর অনুগ্রহেই আপনি তাদের প্রতি কোমলচিত্ত। যদি রুক্ষভাষী ও কঠোর হতেন, তবে তারা আপনাকে ছেড়ে দূরে চলে যেত।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৪৯)।

‘দয়া’ মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা আন্তর্জাতিক জীবনে খুবই প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ছোট এই একটি শব্দে লুকিয়ে আছে হৃদয়স্পর্শী গোটা জগতের শক্তি। মানুষের প্রতি মানুষের দয়া, অপরের দুঃখে-দুঃখিত হওয়া, দুঃখ মোচনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করাই যে মানুষের পরম ধর্ম। সে কথাই তিনি বিশ্বলোকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।’ (মুসলিম : ২৩১৯)।

এখানে বোধগম্যে বিষয় হচ্ছে, নবীজি (সা.) তাঁর অমূল্য বাণীতে শুধু ‘মুসলিম’ বা ‘মুমিন’ শব্দ উচ্চারণ করেননি। বরং সার্বজনীনভাবে ‘মানুষ’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। কেননা, মানুষের জন্যই তো ধর্ম। তায়েফের সেই মর্মান্তিক ঘটনা কে না জানে? নবীজি আমার সেখানে আল্লাহতায়ালার কথা বলতে গিয়ে পাথরের আঘাতে জর্জরিত হলেন, রক্তাক্ত হলেন। তখন আল্লাহতায়ালার আদেশে ফেরেশতা এসে বললেন, ‘আদেশ করুন, দুই পাহাড় একত্র করে এদের পিষে ফেলি।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘না, এদের পরপ্রজন্ম হয়তো ইসলাম গ্রহণ করতে পারে।’ (বোখারি : ৩২৩১)।

নবীজি (সা.) অমুসলিম নাগরিকদের প্রতিও ছিলেন দয়ার সাগর। তাদের অধিকারপ্রাপ্তির ব্যাপারে তিনি মুসলমানদের অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলিম অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার ওপর সাধ্যাতীত বোঝা (জিজিয়া বা প্রতিরক্ষা কর) চাপিয়ে দেয় অথবা তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষাবলম্বন করব।’ (বায়হাকি, মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার : ৫৭৫০)।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাশ দিয়ে একবার এক লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি তা দেখে দাঁড়ালেন। সাহাবারা বললেন, এ তো ইহুদির লাশ! রাসুল (সা.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, সে কি মানুষ নয়? (বোখারি : ১৩১২)। সুবহানাল্লাহ! মানবতার কি দারুণ নিদর্শন।

নবীজি (সা.)-এর দয়ার পরশ শুধু মানবজাতিকেই সিক্ত করেনি, করেছে বাকহীন পশু-পাখির জগৎকেও। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমরা এক সফরে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এক সময় একটু প্রয়োজনে দূরে গেলাম। দেখলাম একটি লাল পাখি, সঙ্গে দুটি বাচ্চা। আমরা বাচ্চা দুটি ধরে নিয়ে এলাম। কিন্তু মা পাখিটিও চলে এলো। বাচ্চা দুটির কাছে আসার জন্য পাখিটি মাটির কাছে অবিরাম উড়ছিল। তখন রাসুল (সা.) এসে পড়লেন। তিনি এটি দেখে বললেন, কে এ বাচ্চা ধরে এনে এদের মাকে কষ্ট দিচ্ছে? যাও, বাচ্চা দুটি মায়ের কাছে রেখে এসো।’ (আবু দাউদ : ১৪৬/২)। দয়া মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা আর্ন্তজাতিক জীবনে খুবই প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ছোট এই একটি শব্দে লুকিয়ে আছে হৃদয়স্পর্শী গোটা জগতের শক্তি, মহত্ত্ব আর মুক্তি। সে জন্যই আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবকে সৃষ্টিজগতের জন্য মনোনীত করেছেন রাহমাতুল্লিল আলামিন হিসেবে। নবীজি (সা.) এমনই দয়াশীল ছিলেন, যাঁর দয়ার বর্ণনা লিখে বা বলে শেষ করার মতো নয়। এক কথায় তিনি ছিলেন দয়ার সাগর। তিনি মানুষকে বিভক্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেতুবন্ধ।

লেখক : ইমাম ও খতিব, কসবা জামে মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত