ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কোরআনের কাহিনি

বাঁধভাঙা বন্যার গল্প

রায়হান রাশেদ
বাঁধভাঙা বন্যার গল্প

ইয়েমেনের রাজধানী সানআ থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে মাআরিব শহর। মাআরিবে ছিল সাবা সম্প্রদায়ের বসতি। কোরআনে একটি সুরা আছে, সুরা সাবা। রানি বিলকিস ছিলেন সাবা সম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী। তারা ছিল বণিক জাতি। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ১১০০ সাল থেকে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ-অঞ্চলে তাদের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের শহরের অবস্থান ছিল দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায়। নদী-নালা, খাল-বিল কিছুই ছিল না। বাগান ও কৃষিজমিগুলো বড় আকালে পড়ে যেত সময়ে-অসময়ে।

বৃষ্টির পানি কিংবা পাহাড়ি ঝর্নার ওপর ভরসা করতে হতো তাদের। কিন্তু অনেক পানি মরুভূমিতে মিশে গিয়ে নষ্ট হয়ে যেত। কখনো উভয় পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি বন্যার মতো নেমে শহর ভাসিয়ে দিত। দেশের সম্রাটরা উত্তরণের পথ খুঁজতে লাগলেন। আল্লাহ তাদের সহায় হলেন। ইয়েমেনের আশপাশের শহর ও বসতিগুলোতে নির্মাণ তারা করলেন একশটির বেশি বাঁধ। মাআরিব শহরের দক্ষিণ পাশে ডানে ও বাঁয়ের পাহাড়ের মাঝখানে উজাইনাহ উপত্যকায় প্রায় ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নির্মাণ করলেন এই বাঁধের একটি; যাকে সাদ্দে মাআরিব বা মাআরিব বাঁধ বলা হতো। কেউ বলেছেন এ বাঁধটি ছিল দুই বর্গমাইল, আবার কেউ বলেছেন, বাঁধটি ছিল মূলত ১৫০ ফুট লম্বা ও ৫০ ফুট প্রশস্ত একটি প্রাচীর। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২/১৫৯)।

পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল ও বৃষ্টির পানি জমা হতো বাঁধে। বাঁধের ওপরে-নিচে ও মাঝখানে পানি বের করার তিনটি দরজা ছিল। দরজা দিয়ে সঞ্চিত পানি সুশৃঙ্খলভাবে শহরের লোকজন ও তাদের খেত-খামার এবং পৌঁছানো হতো। প্রথমে ওপরের দরজা, এরপরে মাঝখানের এবং সর্বশেষ নিচের তৃতীয় দরজা খুলে দিয়ে বছরব্যাপী পানির সংকট কাটানো হতো। পরের বছর পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টির পানিতে ভরে উঠত বাঁধ। বাঁধের নিচে পানির আধার নির্মাণ করে বিরাট বিরাট খালের মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন দিকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা ছিল। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা : ১১০৯)

এই বিশাল বাঁধ অন্যান্য বাঁধ থেকে পুরো দেশকে এমনভাবে জলতৃপ্ত করত, চতুর্দিকে শুধু বাগান আর বাগান দেখা যেত। মাইলের পর মাইল সবুজ শ্যামলিমায় ছেয়ে থাকত। চারপাশের খেজুরের বাগানগুলো খেজুরের কাঁদিতে নুইয়ে পড়ত। নানা ধরনের ফলফলাদিতে ভরে উঠত গাছগুলো। সুগন্ধ দ্রব্যসমূহের খেত, তৃণভূমি, দারুচিনি, আগর ও অন্যান্য সুগন্ধযুক্ত বৃক্ষের ঘন উদ্যান এত বেশি সৃষ্টি হয়েছিল যে গোটা এলাকাটি পুষ্পোদ্যান ও স্বর্গে পরিণত হয়েছিল। কাতাদাহ (রা.) বলেন, কেউ মাথায় খালি ঝুড়ি নিয়ে পথ ধরে গেলে গাছ থেকে পতিত ফলে ঝুড়ি ভরে যেত। (তাফসিরে ইবনে কাসির)। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সাবার অধিবাসীদের জন্য তো তাদের বাসভূমিতে ছিল নিদর্শন: দুটি উদ্যান, একটি ডানদিকে, অপরটি বামদিকে। (তাদের বলা হয়েছিল, হে সাবার অধিবাসীরা) তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রদত্ত রিজিক ভোগ করো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। উত্তম নগরী ও ক্ষমাশীল প্রতিপালক।’ (সুরা সাবা, আয়াত : ১৫)

সাবা ছিল শান্তিকামী, নিরাপদ ও সুখী রাজ্য। তাদের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় হতো প্রাসাদ ও অট্টালিকা নির্মাণে। পথঘাট সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। আরামণ্ডআয়েশ, উন্নতি ও সভ্যতার সব উপকরণ পূর্ণমাত্রাই বিদ্যমান ছিল। শহরে পোকামাকড়, মশা-মাছি ও সাপ-বিচ্ছুর মতো ইতর প্রাণীর নামগন্ধও ছিল না। বাইরে থেকে কোনো ব্যক্তি শরীরে বা কাপড়ে উকুন ইত্যাদি নিয়ে এ শহরে এলেও সেগুলো আপনাই মারা যেত। সাবা থেকে শাম দেশ পর্যন্ত ৭০০ গ্রাম আবাদ ছিল। সকাল বেলা এক জনপদ থেকে রওনা হলে দুপুরে আরেক জনপদে পৌঁছে যেত। সেখানে থেকে খেয়েধেয়ে অনায়াসেই অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল। কোরআনের ভাষায় ‘উত্তম নগরী’ হয়ে উঠেছিল সাবা।

এত নেয়ামত, সমৃদ্ধি এবং সুখী জীবনের পরও সাবাবাসী আল্লাহর নাফরমানি করল। আল্লাহ তাদের কাছে পথপ্রদর্শক পাঠালেন; যিনি তাদের আল্লাহর ইবাদত করার আদেশ দিলেন এবং কৃতজ্ঞতা আদায় করতে বললেন। তারা মুখ ফিরিয়ে নিল। বাঁধ ভাঙার ভয় দেখানো হলো তাদের। ইবনে কাসির ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহের সূত্রে বলেন, তাদের ধর্মগ্রন্থে লেখা ছিল, বাঁধটি ইঁদুরের মাধ্যমে ধ্বংস হবে। ফলে তারা ইঁদুর নিধনের জন্য বিড়াল পুষতে লাগল। তবে আল্লাহর ইচ্ছাকে রোখার সাধ্য কার? সেই বাঁধে এতই ইঁদুর এলো যে বিড়ালরা হার মানল। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইঁদুরগুলো বেশ বড় বড় ছিল এবং বাঁধের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত মাটি নষ্ট করে ফেলেছিল। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা : ১১০৯)।

বিশাল বাঁধ একদিন ভেঙে পড়ল। সেই জলাধার থেকে বেরিয়ে আসা প্রচণ্ড স্রোত, পথিমধ্যে যতগুলো বাঁধ পেয়েছিল সবগুলো ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল। মাআরিব ও আশপাশের ভূভাগকে প্লাবিত করল। সুশোভিত ও মনোরম উদ্যানগুলোকে ডুবিয়ে দিয়ে নষ্ট করে ফেলল। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হলো। মানুষ মারা পড়ল। যারা শহর ছেড়ে আগে চলে গিয়েছিল তারা বেঁচে রইল। বন্যার পানি ধীরে ধীরে শুকিয়ে এলো। তখন ওই স্বর্গসম উদ্যানগুলোর জায়গায় পাহাড়ের দুইপাশের উপত্যকার উভয় পাশে ঝাউ গাছের ঝাড়, জংলি বরইয়ের ঝোঁপ ও সারি সারি পিলু গাছ উৎপন্ন হলো। আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু তারা (আল্লাহর কাছ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিল। কাজেই আমি তাদের

বিরুদ্ধে পাঠালাম বাঁধ-ভাঙা বন্যা, আর আমি তাদের বাগান দুটিকে পরিবর্তিত করে দিলাম এমন দুটি বাগানে যাতে জন্মিত বিস্বাদ ফল, ঝাউগাছ আর কিছু কুল গাছ। অকৃতজ্ঞতাভরে তাদের সত্য প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমি তাদের এ শাস্তি দিয়েছিলাম। আমি অকৃতজ্ঞদের ছাড়া এমন শাস্তি কাউকে দিই না। তাদের এবং যেসব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ বর্ষণ করেছিলাম সেগুলোর মাঝে অনেক দৃশ্যমান জনপদ স্থাপন করে দিয়েছিলাম এবং ওগুলোর মাঝে সমান সমান দূরত্বে সফর মনজিল করে দিয়েছিলাম। (আর তাদের বলেছিলাম) তোমরা এ সব জনপদে রাতে আর দিনে নিরাপদে ভ্রমণ করো। কিন্তু তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের সফর-মঞ্জিলগুলোর মাঝে ব্যবধান বাড়িয়ে দাও। তারা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছিল। কাজেই আমি তাদের কাহিনি বানিয়ে ছাড়লাম (যে কাহিনি শোনানো হয়) আর তাদের ছিন্ন ভিন্ন করে দিলাম। এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা সাবা, আয়াত : ১৬-১৯)

বাঁধটি বর্তমান সানআর মাআরিব প্রদেশের বালাখ হিলস এলাকার ওয়াদি আল-আজানায় অবস্থিত। বাঁধের কিছু ধ্বংসাবশেষ এখনও সেখানে আছে বলে ধারণা করা হয়। (দেশ-দেশান্তর, ৩/৩০৯)। রাজ্য হিসেবে সাবার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় দাউদ (আ.)-এর জাবুরে। এ থেকে প্রমাণিত হয় সাবার সমৃদ্ধির যুগের সূচনা হয়েছিল ১ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। (আজ-জাবুর, ৭২/১০)। সাইয়েদ সুলাইমান নদভির মতে, সাবার উন্নতি ও সমৃদ্ধির সূচনাকাল কিছুতেই ১১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের আগে নয়। (আল-কোরআনের ভৌগোলিক ইতিহাস, সাইয়েদ সুলাইমান নদভি, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আইনী, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৩০৬)।

লেখক : আলেম ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত