
আমরা প্রতিনিয়ত অসংখ্য ভুল করি, কিন্তু নিজেদের ক্রুটি চোখে পড়ে না। কেউ ধরিয়ে দিলেও স্বীকার করতে কষ্ট হয়, সংশোধন করতে আরও কষ্ট হয়। অথচ আমরা অন্যের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়াতে ব্যস্ত থাকি। নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা না করে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিতে আমরা পটু হয়ে উঠি। কখনও কখনও আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগি, যা একজন মোমিনের জন্য শোভনীয় নয় এবং কল্যাণকরও নয়। এই আত্মতুষ্টি আত্মশুদ্ধির পথে প্রধান অন্তরায়। অন্যের দোষ নিয়ে সমালোচনা করার আগে নিজের ক্রুটি সংশোধন করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব : আত্মশুদ্ধি একজন মোমিনের জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটি নিজের নফসের হিসাব নেওয়া এবং আখেরাতের জন্য প্রস্তুতির একটি অপরিহার্য অংশ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে তার নফসের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে; আর দুর্বল সেই ব্যক্তি, যে নিজের নফসের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং আল্লাহর কাছে আশা-আকাঙ্ক্ষা রাখে।’ (তিরমিজি : ২৪৫৯)। এই হাদিস আমাদের নিজের আমলের প্রতি দায়িত্বশীল হতে এবং কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে উৎসাহিত করে। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলতেন, ‘তোমরা হিসাবের মুখোমুখি হওয়ার আগে নিজেদের হিসাব নিয়ে নাও।’ তিনি রাতে নিজের পায়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করে বলতেন, ‘তুমি আজ কী কাজ করেছ?’ (আবু নুআইম আল-আসফাহানি, মিনহাজুল মুসলিম, পৃষ্ঠা : ১২১)। এই অভ্যাস আমাদের নিজেদের প্রতি সৎ ও সচেতন থাকার শিক্ষা দেয়।
নিজেকে চেনা ও সংশোধন : ইমাম ইবনুল কাইয়ুম (রহ.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে ভালোভাবে চিনতে পেরেছে, সে অন্যের দোষ-ক্রুটি বাদ দিয়ে নিজের সংশোধনে মনোনিবেশ করেছে।’ (ইবনুল কাইয়ুম, আল-ফাওয়াইদ, পৃ. ১৮৩, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া)। নিজেকে চেনা আত্মশুদ্ধির প্রথম ধাপ। আমরা যদি নিজেদের ত্রুটি উপলব্ধি করতে পারি এবং সেগুলো সংশোধনের চেষ্টা করি, তবেই অন্যকে সঠিক পথে আনার যোগ্যতা অর্জন করতে পারব।
মানুষ হিসেবে ভুল করা স্বাভাবিক, কিন্তু ভুলের উপর স্থির থাকা বোকামি। নিজের ভুল স্বীকার করা, তা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং সংশোধনের পথে এগিয়ে যাওয়াই মোমিনের বৈশিষ্ট্য। আত্মশুদ্ধির জন্য নফসের কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। যদি আমরা নিজেদের নফসকে কাবু করতে পারি, তবে অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানোর পরিবর্তে নিজের আমলের প্রতি মনোযোগী হতে পারব। কারণ, আখিরাতে প্রত্যেকে নিজের আমলের জন্যই দায়ী থাকবে; অন্যের গুনাহের বোঝা আমাদের কাঁধে চাপানো হবে না।
অন্যকে উপদেশ দেওয়া : অন্য কেউ ভুল করলে তাকে সুন্দরভাবে উপদেশ দেওয়া ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে লাগাতার তীর্যক সমালোচনা মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়, যা কখনও কল্যাণকর নয়। গঠনমূলক সমালোচনা ও সুন্দর নাসীহা মানুষকে সঠিক পথে আনতে পারে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দ্বীন হলো উপদেশের নাম।’ (মুসলিম : ৫৫)। এই উপদেশ হতে হবে আন্তরিক, সুন্দর এবং কল্যাণকামী।
সংকট উত্তরণে প্রয়োজন তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি : অন্যদিকে, যদি কেউ আমাদের ভুল ধরিয়ে দেয়, তবে তা অহংকার না করে বিনয়ের সঙ্গে মেনে নেওয়া উচিত। এটি একজন মোমিনের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য। ভুল স্বীকার করা এবং সংশোধনের পথে এগিয়ে যাওয়া আত্মশুদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
আত্মশুদ্ধি একজন মুমিনের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। এটি শুধু নিজের ভুল সংশোধনের প্রক্রিয়া নয়, বরং আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি পথ। নিজের নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, নিজের আমলের হিসাব নিয়ে এবং আল্লাহর আনুগত্যে জীবনযাপনের মাধ্যমে আমরা আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে পারি। অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানোর পরিবর্তে নিজেকে সংশোধন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আত্মশুদ্ধির এই প্রচেষ্টা আমাদের আখিরাতের জন্য প্রস্তুত করে এবং দুনিয়াতেও একজন সত্যিকারের মোমিন হিসেবে সম্মানিত করে।