পাহাড় ও ঝরনার অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধতা ছড়ানো মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুড়া, খারনৈ ও রংছাতি ৩টি ইউনিয়ন। লেঙ্গুড়া বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তবর্তী জেলা নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানার অন্তর্ভুক্ত একটি ইউনিয়ন। এর উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য ও সুবিস্তীর্ণ গাছপালা ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ একটি পাহাড়ি জনপদ। খুব কাছে থেকে মেঘালয়ের পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করার মত একটি মনোরম স্থান লেঙ্গুড়া। পর্যটকের মন কেড়ে নেওয়ার মতো মনোরম পরিবেশ রয়েছে এখানে। কাজেই বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন এলাকাবাসী।
টংক আন্দোলনের আত্মহুতির ইতিহাস বিজড়িত স্থান লেঙ্গুড়া। সুসং মহারাজের শাসনের বিরুদ্ধে তারই ভাগনে কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন এই পরগনার নিপীড়িত জনগণ। তারই লেশ ধরে লেঙ্গুড়াতেও টংক আন্দোলন দানা বাঁধে। কমরেড রাশিমনি হাজং এর নেতৃত্বে হাজার হাজার হাজং সম্প্রদায়ের লোকজন লেঙ্গুড়া ইপিআর ক্যাম্প ঘেরাও করলে ইপিআরের গুলিতে শত শত লোক মারা যায়, তাদেরকে পুরাতন ইউনিয়ন পরিষদ ভবন সংলগ্ন গণকবরে সমাহিত করা হয়।
১৯৭১ এর গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বীর সেনানিরা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এই লেঙ্গুড়ার মাটিতে। ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই দিনটি কলমাকান্দাবাসীর জন্য এক হ্নদয় বিদারক দিন। এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে সম্মুখ যুদ্ধে সাত বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন।
সীমান্তবর্তী এই জনপদটির উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে চুনামাটি, শ্বেত মৃত্তিকা, সিলেট বালি, নুড়ি পাথর ও কয়লা ইত্যাদি। এখানে উৎপাদিত ফসল সমূহের মধ্যে ধান ও পাট উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া আনারস, কমলা, জুস ও বিভিন্ন প্রকার ফলমূল এখানে পাওয়া যায়। এসব প্রাকৃতিক সম্পদ ও উৎপাদিত ফসল দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাতকরণ সম্ভব। তবে এজন্য ব্যবসায়ীদের সুদৃষ্টি প্রয়োজন।
লেঙ্গুড়া ইউনিয়নকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে গণেশ্বরী নদী, তারই তীরে লেঙ্গুড়া বাজার অবস্থিত। গনেশ্বরী নদীতে শীত মৌসুমে বালি দিয়ে অস্থায়ী বাঁধ তৈরি করে এক বিরাট সেচ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়। যার ওপর নির্ভর করে লেঙ্গুড়া খারনৈ ও নাজিরপুর ইউনিয়নের শত শত একর জমি বোরো চাষের আওতায় আনা হয়। এখানে কোন প্রকার যান্ত্রিক কৌশল ও জ্বালানি তেলের ব্যবহার ছাড়াই প্রাকৃতিক পানির উপর নির্ভর করে কৃষি নির্ভরশীল এই জনপদের মানুষগুলো হাজার হাজার মেট্রিক টন ফসল উৎপাদন করে আসছে, যাতে করে প্রতি বছর সরকারের জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে। কিন্তু আজও অত্র এলাকার মানুষ সেই অস্থায়ী বালির বাঁধের ওপর নির্ভরশীল।
লেঙ্গুড়া বাজারের উত্তরে ফুলবাড়ি গ্রামের বাংলাদেশ সীমান্ত পিলার নং ১১৭২ থেকে মাত্র ৭/৮ কি.মি. উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সর্ববৃহৎ নংগাল কয়লা খনিটি অবস্থিত। নংগাল থেকে উত্তোলিত কয়লা ট্রাকে করে ৪০/৫০ কি.মি. পথ অতিক্রম করে সুনামগঞ্জ জেলার তাহেরপুর উপজেলার বড়ছড়া স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে আমদানি করা হয়।
তার পার্শ্ববর্তী পূর্বদিকে ইউনিয়ন খারনৈ ও রংছাতি। এই রংছাতি ইউনিয়নে একটি প্রাগৈতিহাসিক অবস্থান জড়িয়ে আছে, বর্তমান শতাব্দী হতে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে হিমালয় পর্বতের পাশে ভারতের আসাম, মিজোরাম প্রদেশে এক ভয়াবহ ভূ-কম্পনের মাধ্যমে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটে। ফলে হিমালয়ের অনুবৃত্তি পাহাড় পর্বতমালা ও টিলার সৃষ্টি হয়, যা শক্ত পাথর ও বেলেমাটি দ্বারা সৃষ্টি। তখন থেকে স্থানটি এক বড় (ডিঙা) নৌকা সদৃশ মাস্তুলের মতো দেখা যায়।
কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের চন্দ্র ডিঙা হরিপুর গ্রাম, বাংলাদেশ বিডিআর ক্যাম্প পাঁচগাও থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে সম্পূর্ণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত।
পরিশেষে প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি সৌন্দর্যের আধার এই মনোরম পাহাড়ি স্থানটি দেশি বিদেশি পর্যটকদের জন্য এক অতি আকর্ষণীয় স্থান।