মনোয়ারা মাথায় কাপড় ও পানি ভর্তি কলসি নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। হঠাৎ হাত থেকে কলসি ছেড়ে দিয়ে এক দৌড়ে স্বামীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল- ‘কি হয়েছে আপনার? আমার কী হয়েছে জানি না, শরীরটা ভালো লাগছে না। চলুন, ঘরে চলুন।’ মনোয়ারার স্বামী বিষণ্ণ স্বরে বললেন, ‘আমি মনে হয় আর ঘরে ফিরতে পারব না...’ মনোয়ারা চিৎকার করে উঠলেন, ‘এ কথা বলবেন না! আপনি ভালো হয়ে যাবেন।’ তিনি ধীরে ধীরে বললেন, ‘আমার পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার ডাক এসেছে... আমি চলে যাচ্ছি। আমার তিন মেয়েকে দেখো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’ সিকদার পৃথিবী ছেড়ে চলে যান... স্তব্ধ হয়ে যায় মনোয়ারা। অকালে স্বামীর মৃত্যু! বাচ্চা তিনটিকে নিয়ে মনোয়ারা কীভাবে জীবন চালাবেন, তা ভাবতে ভাবতে তিনি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন-স্বামী যা রেখে গেছে তা দিয়েই সুন্দরভাবে চলতে পারবেন, কারো কাছে কিছু চাইতে হবে না।
বিধবা মানুষের বাড়িতে নানাজন নানা কথা বলতে আসে। মনোয়ারার তিন মেয়ে-এনি, রিফা, লতা। বড় মেয়ে এনির রূপ ও বয়স ক্রমেই তার আশপাশের মানুষের নজরে আসে। এলাকার রশিদ প্রায়ই মনোয়ারার বাড়িতে আসে। একদিন এনিকে দেখে বলে, ‘আপনার এনি দেখতে বেশ সুন্দর!’ এই মন্তব্যে মনোয়ারার মনে সন্দেহ জাগে। তিনি কপাল কুঁচকে ফেলেন। রশিদ আরও বলে, ‘আপনার যখন যা লাগে, বলবেন, আমি দেবো। আপনার বলতে দেরি হবে, আমার দিতে দেরি হবে না।’ মনোয়ারা কঠিন স্বরে জবাব দেন, ‘আপনি আমাকে কিছু দেবেন, সে কথা বলছেন কেন? আমি কি কারো কাছে কিছু চাই?’ রশিদ ধূর্ত হাসি দিয়ে বলে, ‘আপনি চাইছেন সেটা তো আমি বলি নাই। লাগলে বলবেন, আমি দেবো।’ মনোয়ারা এবার বুঝতে পারেন- এইসব লোকের সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই, এতে শুধু সময় ন’ হবে।
মনোয়ারা মেয়েদের সর্বদা চোখে চোখে রাখেন। দিনকাল ভালো না-কখন কী ঘটে যায়, বলা যায় না। তাই তিনি তিন মেয়েকে কাছে নিয়ে সতর্ক করেন- ‘যখন-তখন বাইরে যাবে না। রাস্তাঘাটে সাবধান হয়ে চলবে।’ কিন্তু একদিন রশিদ বিনা অনুমতিতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে, এমন ভাব যেন এটা তার নিজের বাড়ি! নিজে থেকেই আলাপজুড়ে বসে- ‘এই দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম আপনাদের দেখে যাই।’ মনোয়ারা চুপচাপ বসে থাকেন। মুখ মলিন। রশিদ কটাক্ষ করে বলে, ‘শাশুড়ি আম্মা, আপনি মুখ কালো করে বসে আছেন কেন?’ মনোয়ারা এবার আর চুপ থাকলেন না। ‘আপনার শাশুড়ি কে? আমাকে শাশুড়ি ডাকছেন কেন?’ রশিদ নির্লজ্জভাবে হাসে, ‘আমি আপনার মেয়ে এনিকে বিয়ে করবো! তাই আপনি আমার শাশুড়ি। বিয়ের আগেই শাশুড়ি বলে অভ্যাস করছি।’
মনোয়ারা হতভম্ব হয়ে যান। ‘হায় হায়! এই লোক কতটা নির্লজ্জ! আমার এতটুকু মেয়ের দিকে চোখ পড়েছে?’ তিনি কঠিন স্বরে বলেন, ‘আপনি আমার বাড়ির সীমানায় আসবেন না!’ রশিদ মুচকি হেসে চোখ রাঙিয়ে বলে, ‘আপনি আমাকে অপমান করলেন, তার কণ্ঠে ছলনা লুকিয়ে আছে- ‘না না, আমি অপমান বোধ করিনি। কারণ আপনি আমার শাশুড়ি, আমার গুরুজন। আপনার কথায় অপমান বা রাগ করা চলে না।’ মনোয়ারার ভয়ে গা কাঁপতে থাকে। তারই মাঝে এনি সামনে এসে যায়। মনোয়ারা তড়িঘড়ি কাপড়ের আঁচল দিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। রশিদ এনিকে দেখে চোখ বড় বড় করে বলে, ‘ওহ! তুমি আমার কথা শুনে চলে এসেছো! ঘরে থাকতে পারোনি বুঝি?’ মনোয়ারা এবার চিৎকার করে ওঠেন- ‘কী সব বাজে কথা বলছেন আপনি! আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান!’ রশিদ দরজা পেরিয়ে যেতে যেতে মুচকি হেসে বলে, ‘যাচ্ছি, তবে আবার আসব।’
মনোয়ারা মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে রশিদের সঙ্গে দেখা। সঙ্গে আরও কিছু বকাটে ছেলে। হঠাৎ রশিদ তার সঙ্গীদের নির্দেশ দিল- ‘ওই মেয়েটাকে তুলে নিয়ে চল, ওরে আমার বউ করব!’
পোলাপানরা রশিদের হুকুমে এনিকে জোরপূর্বক ধরে। মনোয়ারা চিৎকার করে ওঠেন- ‘কে কোথায় আছেন? আমার মেয়েকে বাঁচান!’ কেউ এগিয়ে আসে না। এনিও চিৎকার করে বলে- ‘মা, আমাকে বাঁচাও!’ মেয়ের কান্নায় মায়ের বুক ফেটে যায়। মনোয়ারা হতভম্ব। তিনি বুঝতে পারেন না, কার কাছে বিচার চাইবেন? কোথায় যাবেন? এদিক-ওদিক দৌড়ে মেয়েকে খুঁজতে থাকেন। রশিদ তার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ংকর ধমক দেয়- ‘থানা-পুলিশ করলে তোর মেয়েকে মেরে ফেলব! সঙ্গে বাকি দুই মেয়েকেও!’ মনোয়ারার যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। রশিদ আরও বলে, ‘এখনো তো সম্মান দিয়ে কথা বলছি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে সম্মান আর দেবো না, শুধু সম্মান নেব!’
মনোয়ারা দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এনির মুখ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে- ‘মা, আমি বড় অসহায়...।’
দুই-তিন দিন কেটে যায়। এনিকে উদ্ধার করতে পারেন না। একদিন হঠাৎ রশিদ এনিকে নিয়ে মনোয়ারার বাড়িতে ফিরে আসে। মেয়েকে ফিরে পেয়ে মনোয়ারা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। মেয়েকে ফিরে পেলেন, কিন্তু এ কেমন ফিরে আসা? রশিদ হেসে বলে- ‘এবার আমার সঙ্গে এনির বিয়ে দিন!’ মনোয়ারা কাঁপতে কাঁপতে বলেন- ‘আমি কখনোই আমার মেয়েকে আপনার সঙ্গে বিয়ে দেবো না!’
রশিদ ঠান্ডা কণ্ঠে বলে, ‘বিয়ে দিলে দেন, না দিলে না দেন, সেটা আপনার ইচ্ছা। কিন্তু সমাজ এখন আপনাকে ভালো বলবে কি? আপনার মেয়ে দুই-তিন দিন আমার কাছে ছিল!’ রশিদ ঠোঁটে কুটিল হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘এখন যে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি, এটা তো আপনার জন্য অনেক কিছু! আমি মানুষটা অত খারাপ না, একটু হলেও দয়া-মায়া আছে!’ মনোয়ারা বাকরুদ্ধ হয়ে যান। এই সমাজ! এই নিষ্ঠুর সমাজ! তার মেয়ের জীবন কি এক নিষ্ঠুর খেলায় পরিণত হয়েছে?
রশিদ মানুষের মাধ্যমে নানা কথা ছড়ায় মনোয়ারার মেয়ে এনির সম্পর্কে- ‘এনি এতদিন কোথায় ছিল?’ ‘ওর ইজ্জত মান কি আর আছে?’ সমাজের তীক্ষè কটাক্ষে মনোয়ারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। এই সমাজ কটু কথা দিয়ে মানুষকে বিষিয়ে তুলতে পারে, কিন্তু কখনোই সুখ দিতে পারে না! ছোট দুই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মনোয়ারা এনিকে রশিদের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হন। কিন্তু এনি সেই বিয়ে করতে চায় না। এনি ক্রন্দনভরা কণ্ঠে বলে, ‘মা, আমি এই বিয়ে করবো না!’ মায়ের চোখ ভিজে ওঠে। তিনি অসহায়ের মতো মেয়েকে বলেন- ‘মা, আমি যে নিরুপায়, আমাকে ভুল বুঝিস না!’ এনি বাধ্য হয়ে রশিদকে বিয়ে করে।
রশিদ এনিকে তার বাড়ি নিয়ে যায়। সেদিন রাতেই সে আত্মহত্যা করে। এই খবর শুনে মনোয়ারা ছুটে যান রশিদের বাড়িতে। তিনি মেয়ের নিথর দেহ দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। চোখের সামনে যে সর্বনাশের ছায়া আঁকা ছিল, সেটাই বাস্তবে পরিণত হয়েছে! তিনি ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন! অনেকক্ষণ পর তাঁর চেতনা ফিরে আসে। আকাশভেদী আর্তনাদ করে ওঠেন- ‘সমাজের কটুবাক্যের জন্য আমি মেয়েকে রশিদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম! আজ আমার মেয়ে কোথায়?’ ‘সমাজ, আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও!’ কিন্তু সমাজ নির্বিকার। এখানে সব লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার ভাগ মেয়েরই একা বহন করতে হয়। পুরুষ শাসিত এই সমাজে যে মেয়েকে লাঞ্ছিত করে, সে দিব্যি বুক ফুলিয়ে চলে। আর ভুক্তভোগী মেয়ে-তার কণ্ঠস্বর চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায়।
মনোয়ারা মামলা করেন। তিনি মেয়ে হত্যার বিচার পাবার অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু তিনি কি সত্যিই বিচার পাবেন? নাকি আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যাবে সেই দুশ্চরিত্র নারীলোভী রশিদ?