আন্দ্রে দানিয়ার কথা শুনে দুজন আরও বিস্মিত হলো। লোকটা কতটা মানবিক হলে বিপদে পড়েও তাদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে চাচ্ছে, তার ওপরে এই নির্জনেই সে একাকী থাকার চিন্তা করছে। বিষয়টা ভাবতেই পর্যটকরা শিউরে উঠল।
উপাল বলল, ‘আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। তুমি ঠান্ডা মাথায় গাড়িটা ঠিক করার চেষ্টা করো। আরেকটা কথা, তোমাকে বনে ফেলে রেখে কোথাও যাচ্ছি না আমরা।’
নিকোলাস বলল, ‘উপাল তোমার সিদ্ধান্তটাকে সাপোর্ট করলাম; সবাই একসঙ্গেই ফিরে যাব আশা করি।’
গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন। ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ায় গাড়ির ভেতরের তাপমাত্রাও নেমে গেছে। এমনিই তো শহরের চেয়ে এদিকে প্রচন্ড ঠান্ডা; শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে। ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে গলায় ভোদকা ঢালা ছাড়া আর কোন বিকল্প ব্যবস্থাও নেই। শরীরের তাপ ধরে রাখতে না পারলে কঠিন বিপদে পড়তে হবে সবাইকে।
নিকোলাস বোতলের ছিপি খুলে কয়েক চুমুক ভোদকা গিলে বোতলটা উপালের হাতে দিলো। দুজন একটু একটু করে ভোদকা গিলছে আর চালক ইঞ্জিন ঠিক করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সবাই যখন চিন্তিত, ঠিক তখনই দেখতে পেলো গাড়ির কয়েক ফুট পেছন দিয়ে একটা বলগা হরিণ ক্ষিপ্র গতিতে দৌড়ে পাইন বনের গহিনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
প্রাকৃতিক পরিবেশে হরিণটাকে দৌড়ে যেতে দেখে দুজন যেমন আনন্দিত হলো, তেমনি হলো শঙ্কিতও। ভয়ংকর চিতার হিংস্রতার কথা আগে থেকেই জানা আছে তাদের। যদি চিতা বা অন্য কোন হিংস্র প্রাণীরা হরিণটাকে তাড়া করেই থাকে, তাহলে বিপদ অনিবার্য। হরিণের খোঁজ না পেলে নিশ্চয়ই তাদেরকে অনুসরণ করবে প্রাণীটা। তারা সাবধান হলো। আন্দ্রে বলল, ‘তোমরা দ্রুত গাড়িতে উঠো। হরিণটাকে যদি হিংস্র প্রাণীরা তাড়া করেই থাকে তাহলে আমরা নিরাপদ নই।’
আন্দ্রের পরামর্শে দুজন দ্রুত গাড়িতে উঠল। আন্দ্রে গাড়িতে উঠতে গিয়েও থেমে গেল; নিচে দাঁড়িয়ে বলল, ‘পশু নয়, শিকারিরা হরিণটাকে তাড়া করছে। আমরা নিরাপদ। ইচ্ছে করলে তোমরা গাড়ি থেকে নামতে পারো।’
আন্দ্রের কথায় আশ্বস্ত হয়ে পর্যটকেরা নিচে নামল। এমনি সময় তারা দেখতে পেলো অদ্ভুত চেহারার চারজন মানুষ গাড়ির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। ওদের হাতে লম্বা লম্বা লাঠি। লাঠির অগ্রভাগ বর্শার মতো সুচালো। লাঠির আকৃতি দেখে বুঝাই যাচ্ছে সুচালো লাঠি দিয়েই ওরা জীবজন্তু শিকার করে।
শিকারিরা ধীরে ধীরে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। ওদের দেখে পর্যটকদের মুখে আতঙ্কের ছায়া নেমে এলো। শিকারিরা দেখতে সাধারণ কোনো মানুষের মতো নয়, দেহের গড়ন যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি চেহারায় এক ধরনের পাগলাটে ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিকারিদের এমন চেহারা দেখে ভয় আর শঙ্কায় পর্যটকদের শরীর কেঁপে উঠল। তার ওপর চারজন শিকারির গায়ে পশুর চামড়া জড়ানো থাকায় ওদেরকে আরও ভয়ংকর দেখাচ্ছে। ওদের পায়ে মোটা চামড়ার আবরণ, তবে তা জুতার মতো নয়; বরং গোলাকার, অনেকটা ফুটবলের মতো আকৃতি।
শিকারিদের মাথা শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিক বড়, লম্বাটে। ঘাড় প্রায় কাঁধের সঙ্গে মিশে গেছে। হাত-পা মোটা, শক্তপোক্ত। উচ্চতায় পাঁচ ফুটের বেশি হলেও অদ্ভুত গড়নের কারণে দেখতে আরও বৃহৎ লাগছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে। নাকের নিচে পাতলা গোঁফ, আর লম্বা দাড়ি মুখের নিচের অংশ ঢেকে রেখেছে। সবচেয়ে অদ্ভুত তাদের নাক; গোড়ার দিকে মোটা, অগ্রভাগ ঈগলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো। দেখে মনে হচ্ছে নিচের দিকে ঝুলে আছে। সব মিলিয়ে এদের চেহারা মানুষের মতো হলেও সভ্য মানুষের সঙ্গে বিস্তর ফারাক রয়েছে।
লাঠি হাতে চারজন দাঁড়িয়ে থাকলেও আক্রমণাত্মক ভাবভঙ্গি নেই। বরং শিকারিরা যে গাড়ি আর পর্যটকদের দেখে ভয় পাচ্ছে, সেটাই ওদের চেহারায় ফুটে উঠেছে। ভয়ার্ত কণ্ঠে ক্রির..ক্রির.. আওয়াজ করে নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করল শিকারিরা।
শিকারিদের ভয়ার্ত আচরণ লক্ষ্য করে পর্যটকদের উদ্দেশে আন্দ্রে বলল, ‘তোমরা অযথা ভয় পেয়ো না। ওরা আমাদের দেখেই ভয় পেয়েছে; ক্ষতি করবে না। ক্ষতি-টতি করলে এতক্ষণে লাঠিসোঠা দিয়ে আঘাত করত।’
উপাল জানতে চাইল, ‘আন্দ্রে, এমন চেহারার মানুষ তো জীবনে কখনও দেখিনি, তুমি দেখেছ?’
আন্দ্রের সোজাসাপ্টা জবাব, ‘কখনও দেখিনি।’
নিকোলাস জিজ্ঞেস করল, ‘এরা কি আসলেই মানুষ?’
উপাল জোর দিয়ে বলল, ‘মানুষ তাতে সন্দেহ নেই। তবে এস্কিমো কি না, কে জানে।’
আন্দ্রে বলল, ‘এস্কিমোরা এখানে থাকে না, ওরা থাকে তুন্দ্রা অঞ্চলে। তোমরা যাই বলো না কেন, আমি আগে কখনও এমন মানুষ দেখিনি সাইবেরিয়া অঞ্চলে। সম্ভবত এরা কোন আদিম উপজাতিটাতি হবে।’
নিকোলাস বলল, ‘উপজাতি হলেও তো চেহারা সভ্য মানুষের মতোই হওয়ার কথা। এদের সঙ্গে তো কারো চেহারারই মিল খুঁজে পাচ্ছি না। ভয়ংকর অদ্ভুত চেহারা!’
আন্দ্রে বলল, ‘চেহারা নিয়ে পরে ভেবো। আগে জানা দরকার, আশেপাশে রাত কাটানোর কোন ব্যবস্থা আছে কি না।’
আন্দ্রে শিকারিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু ওরা কোনো ভাষাই বুঝতে পারছে না। বিভিন্নভাবে কিছুক্ষণ চেষ্টা করে সে চোখ বন্ধ করে মাথার নিচে হাত দিয়ে শোয়ার ভঙ্গি করে দেখাল। শিকারিদের একজন আন্দ্রের অঙ্গভঙ্গি দেখে বোঝার চেষ্টা করল। বিষয়টা বুঝতে পেরে সে ইশারায় জানিয়ে দিলো যে, আশপাশে কোনো আশ্রয় নেওয়ার জায়গা নেই। আন্দ্রে দানিয়া এবার নতুন কৌশলের আশ্রয় নিলো। সে ইশারায় বোঝাতে চাইল তাদের দলের জন্য রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া সম্ভব কি না। শিকারিদের মধ্যে আরেকজন এবার মাথা ঝাঁকিয়ে স্পষ্টভাবে ‘না’ সূচক উত্তর দিলো। আন্দ্রে দানিয়া নাছোড়বান্দা। সে আবার অনুনয়-বিনয় করে বোঝানোর চেষ্টা করল যে তাদের আশ্রয় দরকার, গাড়িতে রাত কাটানো যাবে না। যদি শিকারিরা একটু সাহায্য করে, তবে তাদের জন্য বিশাল উপকার হবে। শিকারিরা কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে আলোচনা করে ইশারায় জানালো, তারা চাইলে ওদের সঙ্গে যেতে পারে। উপাল বিষয়টাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। চেনা নেই, জানা নেই, হুট করে ওদের সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করল সে। নিকোলাসেরও একই কথা। এবার আন্দ্রে মুখ খুলল, ‘এখানে থাকার চেয়ে ওদের সঙ্গে যাওয়াই ভালো। এই ঠান্ডার মধ্যে গাড়িতে রাত যাপন করা সম্ভব হবে না। ইঞ্জিন চালু থাকলে সম্ভব হতো। আমাদের ফায়ারপ্লেস লাগবে, না হলে সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকাটাই কঠিন হবে। ভেবে দেখো এখানে থাকলেও মরতে হবে, আবার শিকারিদের সঙ্গে গেলেও বিপদের আশঙ্কা রয়েছে, এমতাবস্থায় কী করবে সিদ্ধান্ত নাও তোমরাই।’ চলবে...