প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনাপূর্ণ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িয়ে ফেলার জন্য একটি নাটকীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনা তো দূরের কথা, ট্রাম্প এখন এমন একটি অঞ্চলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যা আরও বড় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এমন একটি যুদ্ধ, যেখানে আমেরিকা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় আমেরিকা হামলা চালিয়েছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা করার মাত্র দুই ঘণ্টা পর, হোয়াইট হাউস থেকে জাতির উদ্দেশে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘অভিযানটি ছিল অসাধারণ সাফল্য।’
তিনি আশা করেন, তার এ পদক্ষেপ আরও স্থায়ী শান্তির দরজা খুলে দেবে; যেখানে ইরানের আর পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। ইরান বলছে, তাদের শক্তিশালী ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্রে স্থাপনার সামান্য ক্ষতি হয়েছে। তবে সময়ই বলে দেবে, কোন পক্ষ সঠিক। এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে সতর্ক করে বলেন, ‘যদি তারা তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বাদ না দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে তারা এমন হামলার মুখোমুখি হবে, যা অনেক ভয়াবহ। অনেক টার্গেট এখনও বাকি। আমেরিকা গতি, নির্ভুলতা এবং দক্ষতার সঙ্গে সেদিকে এগোবে।’ মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ ধরনের বাহাদুরী সত্ত্বেও ইরানে আমেরিকার অব্যাহত সামরিক সম্পৃক্ততা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চল এবং বিশ্বের জন্য সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বয়ে আনতে পারে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করেছেন, ‘আমেরিকা সংঘাত বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার ফলে মধ্যপ্রাচ্য একটি নিয়ন্ত্রণহীন বিশৃঙ্খলার চক্রে পড়ে যেতে পারে।’ তিনি উল্লেখ করেন, অঞ্চলটি এরই মধ্যে সেই পরিস্থিতির দ্বারপ্রান্তে। যদি ইরান প্রতিশোধ নেয়, যেমনটা মার্কিন হামলা হলে ঘটবে বলে সতর্ক করেছিলেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, সেক্ষেত্রে আমেরিকাও জবাব দিতে বাধ্য হতে পারে।
দু’সপ্তাহ পরিণত হলো দুদিনে : গত সপ্তাহের শুরুতে ট্রাম্প যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, ইরানকে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে, সেটা প্রেসিডেন্টকে এমন একটা অবস্থায় ফেলে দেয়, যেখান থেকে তার ফিরে আসা ছিল কঠিন। ইরানও যে হুমকি দিচ্ছিল, সেটাও তাকে একই অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। এভাবেই যুদ্ধ শুরু হয়। এভাবেই যারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যুদ্ধটা তাদের কল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বৃহস্পতিবার ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানিদের দু’সপ্তাহের সময়সীমা দিয়েছিলেন; কিন্তু সেটা যা প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তার চেয়েও কমে আসে মাত্র দুদিনে। শনিবার রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, তিনি পদক্ষেপ নিয়েছেন।
আলোচনা কেবল ভান ছিল : গত সপ্তাহ শেষে ইরানিদের একটা মিথ্যা নিরাপত্তার অনুভূতিতে প্রলুব্ধ করার প্রচেষ্টা ছিল নাকি পর্দার আড়ালে ট্রাম্পের মনোনীত দূত স্টিভ উইটকফের নেতৃত্বে শান্তি আলোচনা ভেস্তে গেছে? হামলার পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে এর ফলাফল খুব কমই জানা যায়। কিন্তু ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট এবং টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে শান্তির দ্বার উন্মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তবে এটি হয়তো অতিরিক্ত আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ, ইসরায়েল ইরানের সামরিক সক্ষমতা দুর্বল করতে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালালেও আয়াতুল্লাহর হাতে এখনও অনেক অস্ত্র রয়েছে। তবে পরিস্থিতি দ্রুত জটিল হয়েও উঠতে পারে। এখন অপেক্ষার পালা। ইরান তার তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার প্রতিক্রিয়া কীভাবে দেখাবে, যার মধ্যে ফোর্দোও রয়েছে, যেটিকে তার পারমাণবিক কর্মসূচির রাজকীয় মুকুট হিসেবে দেখা হয়। ট্রাম্প আশা করছেন, মার্কিন হামলা ইরানকে আলোচনার টেবিলে আরও বেশি ছাড় দিতে বাধ্য করবে। কিন্তু এটির সম্ভাবনা খুব কম। কারণ, যে দেশটি ইসরায়েলি হামলার সময় আলোচনায় রাজি নয়, তারা আমেরিকান বোমা পড়ার সময় আরও আগ্রহী হবে; এমনটা ভাবা কঠিন। আর যদিও ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, মার্কিন আক্রমণ ছিল একটি একক ও সফল অভিযান। কিন্তু যদি বাস্তবে তা না হয়, তাহলে আবারও আক্রমণ করার জন্য চাপ বাড়বে অথবা প্রেসিডেন্টকে ন্যূনতম সামরিক লাভের জন্য গুরুতর রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে হবে।
শান্তির দূতের পাল্টা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি : সেই ঝুঁকির মধ্যে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় রাজনৈতিক উদ্বেগের মতো বিষয়ও আছে। ইরানের ওপর মার্কিন হামলার সম্ভাবনা এরই মধ্যে কেবল ডেমোক্র্যাটদের কাছ থেকে নয়, ট্রাম্পের নিজস্ব আমেরিকা ফার্স্ট আন্দোলনের ভেতর থেকেও তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় প্রেসিডেন্টের অস্বাভাবিকভাবে তার তিনজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাকে পাশে রাখা সম্ভবত তার দলের মধ্যে ঐক্য প্রদর্শনের একটি প্রচেষ্টা ছিল। বিশেষ করে ভ্যান্স, যিনি বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের আরও সংযত পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে কথা বলেছেন। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে দাবি করেছেন, ট্রাম্প এখনও একজন অনাক্রমণবাদী এবং তার সমর্থকদের তাকে বেনিফিট অব ডাউট দেওয়া উচিত। যদি এ আক্রমণটি শুধু একবারের জন্য হয়ে থাকে, তাহলে ট্রাম্প হয়তো তার সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে খুব সহজেই বিভক্তি দূর করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু যদি এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বৃহত্তর সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট তার দলের ভেতর থেকেই প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারেন। শনিবারের আক্রমণটি প্রেসিডেন্টের জন্য এমন একটি আগ্রাসী পদক্ষেপ ছিল, যিনি তার প্রথম মেয়াদে কোনো নতুন যুদ্ধ শুরু না করার গর্ব করেছিলেন। গত বছর নির্বাচনি প্রচারে বিদেশি সংঘাতে দেশকে জড়ানো পূর্বসূরিদের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে সমালোচনা করেছিলেন। ট্রাম্প তার পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু এখান থেকে এটি কোথায় যাবে, তা পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই।
যুদ্ধের গতিপথ পাল্টানোতে আমেরিকান হামলা : বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যখন সকালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী অফিসের ভাষণ মঞ্চে দাঁড়ান, তখন তিনি প্রথমে ইসরায়েলের জনগণকে তার সবশেষ যুদ্ধের সর্বশেষ নাটকীয় পরিবর্তনের খবর জানানোর জন্য হিব্রুতে ভাষণ দেননি। এর পরিবর্তে তিনি ইংরেজিতে কথা বলেছেন। ইরানের পরমাণু স্থাপনায় মার্কিন বোমা হামলার পর তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরাসরি প্রশংসা করে তাকে উদ্দেশ্য করেই কথা বলেছেন। যদি নেতানিয়াহুর কথার সুরে বিজয় থাকে এবং তিনি হাসি চেপে না রাখেন, তাহলে সেটাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময় ক্রমাগত সেটাই বলে গেছেন, যেটা তিনি বিশ্বাস করতেন, ইরান ইসরায়েলের জন্য হুমকি। নেতানিয়াহু গত ১৫ বছরের বেশিরভাগ সময় তার আমেরিকান মিত্রদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কেবল সামরিক পদক্ষেপ ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ধ্বংস করতে পারে। ইতিহাস বদলে দেবে, এমন সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি নেতানিয়াহু নিজেকেও এমন একজন মার্কিন রাষ্ট্রপতির মন পরিবর্তনের জন্য অভিনন্দন জানাতে পারেন; যিনি বিদেশে সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। যার সমর্থকরা ইসরায়েলের ইরান যুদ্ধে যোগদানের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। এটাও মনে রাখা উচিত, ট্রাম্পের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরান কত দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করতে পারে, সে সম্পর্কে ইসরায়েলের মূল্যায়ন প্রকাশ করেনি। এমনকি তারা তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা, তাও জানায়নি। এ সংঘাতের পুরো সময় জুড়ে ইসরায়েলের সরকার এবং সামরিক বাহিনী জোর দিয়ে বলেছে, ইরানের হুমকি মোকাবেলা করার সক্ষমতা ইসরায়েলের আছে। কিন্তু এটা কোনো গোপন বিষয় ছিল না, শুধু আমেরিকার কাছেই এমন ভারী অস্ত্র আছে, যা ইরানের বিশেষত পাহাড়ের গভীরে নির্মিত ফার্দোর মতো সবচেয়ে শক্তিশালী মাত্রায় সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনায় ক্ষতি করতে সক্ষম। যদি শনিবার রাতে বোমা হামলার শিকার পারমাণবিক স্থাপনাগুলো এখন সত্যিই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে, তাহলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী তার যুদ্ধের মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বলে ঘোষণা করতে সক্ষম হবেন। সম্ভবত এ সংঘাতকেও একটা শেষের দিকে নিয়ে আসতে পারবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদে ইরানের জবাব : ইরান বলছে, তারা এরই মধ্যে তাদের পারমাণবিক উপকরণ সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু শনিবার রাতের বোমা হামলা না হলেও ইসরায়েলের বিমান বাহিনী বছরের পর বছর ধরে যে লক্ষ্যবস্তুর তালিকা তৈরি করেছে, সেটা ধরে নিজের মতো করেই কাজ চালিয়ে যেত। ইরানের সামরিক বাহিনী, তাদের কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী, সরকারি অবকাঠামো এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর যেসব স্থানে ইসরায়েলের বোমা পৌঁছাতে পারে, সেগুলোর ক্ষয়ক্ষতি চলতে থাকত। তবে নেতানিয়াহু হয়তো এমন কোনো পরিষ্কার ধারণা নাও দিতে পারেন, যেখানে ইসরায়েল বলতে পারে, পারমাণবিক হুমকি নিশ্চিতভাবে নিরসন করা হয়েছে।
সম্ভবত ইরানে কেবল শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনই সেই মুহূর্তটি এনে দিতে পারে। আমেরিকার বি-টু বোমার বিমান নিঃসন্দেহে যুদ্ধের গতিপথ বদলে দিয়েছে। এটি আরও তীব্র হবে কিনা, তা নির্ভর করবে ইরান এবং তার মিত্ররা কীভাবে জবাব দেয়, তার ওপর। গত সপ্তাহে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যুদ্ধে জড়ালে আমেরিকার বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হানা হবে। আমেরিকানদের জানা উচিত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপ নিঃসন্দেহে তার অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হবে। শনিবারই ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইয়েমেনের হুথি গোষ্ঠী হুমকি দিয়েছিল, আমেরিকা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে যাতায়াতকারী মার্কিন জাহাজগুলোতে আক্রমণ করা হবে। এ অঞ্চলে আমেরিকার সামরিক কর্মী, ব্যবসা এবং নাগরিকরা এখন সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু। ইরান যদি ইচ্ছা করে, তাহলে বিভিন্ন উপায়ে পাল্টা হামলা করতে পারে। যেমন- উপসাগরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ বা ঘাঁটিতে আক্রমণ করা, উপসাগর থেকে তেলের প্রবাহ ব্যাহত করা এবং পেট্রোলের দামকে উঠতে দেওয়া। আমেরিকা ইঙ্গিত দিয়েছে, আপাতত তাদের সামরিক পদক্ষেপ শেষ এবং তেহরানের সরকার পতনে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এটি ইরানকে তার প্রতিক্রিয়া সীমিত করতে উৎসাহিত করতে পারে। সম্ভবত মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে এমনভাবে আক্রমণ করতে পারে, যাতে বেশি হতাহতের ঘটনা না ঘটে অথবা একই কাজ করার জন্য আঞ্চলিক সহযোগীদের ব্যবহার করতে পারে। ২০২০ সালে ট্রাম্প ইরানের বিপ্লবী গার্ড নেতা কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার পর ইরান এ পথ বেছে নিয়েছিল। শনিবার রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানের প্রতি যে কোনো পাল্টা হামলার মোকাবেলায় তীব্র শক্তি প্রয়োগে তার নিজের যে হুমকি, সেটার পুনরাবৃত্তি করেন। এখন সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে, এটি এ সংঘাতের সমাপ্তির সূচনা নাকি যুদ্ধের আরও মারাত্মক প্রাণঘাতি পর্যায়ের শুরু?
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক