ঢাকা শনিবার, ০৯ আগস্ট ২০২৫, ২৫ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইরানের সামরিক শক্তির গল্প

হুমাইদুল্লাহ তাকরিম
ইরানের সামরিক শক্তির গল্প

ইরানের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস আড়াই হাজার বছর পুরোনো। তবে আধুনিক সেনাবাহিনী বা অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার শুরুটা হয়েছিল রেজা খান বা রেজা শাহ পাহলভির হাত ধরে। যিনি ১৯২০-এর দশকে সেনাকমান্ডার থেকে পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী ও রাজা হয়েছিলেন। সামরিক বাহিনীর কমান্ডার হওয়ার পর তিনি আরতেশ বাহিনী গঠন করেন। যেটিকে আধুনিক এক সশস্ত্র বাহিনীর সূচনা হিসেবে দেখা হয়। তিনি ইরানকে একটি আঞ্চলিক শক্তিতে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি হাজারো অফিসারকে বিদেশে মিলিটারি একাডেমিতে পাঠিয়েছিলেন। পাশাপাশি নিজ দেশের বাহিনীকে বড় করতে থাকেন। তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পশ্চিমা অফিসারও নিয়োগ দেন।

সমৃদ্ধকরণে নানা পদক্ষেপ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরানের দখল নেয়। নাৎসি জার্মানির সঙ্গে সুসম্পর্কের জেরে রেজা শাহকে সরিয়ে রাজার আসনে আনা হয় তার পুত্র মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে। যিনি শাসনকালের প্রায় পুরোটা সময় পশ্চিমাপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পশ্চিমাদের নজর ছিল ইরানের তেলের দিকে। সেই তেলের টাকায় ৬০ থেকে ৭০ দশকজুড়ে মূলত আমেরিকা থেকে বহু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেনা হয়। ইরানের শেষ শাহ বা রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলভি দেশকে আধুনিকায়ন করতে উদ্যোগ নিলেও জনবিচ্ছিন্নতা, একনায়কতন্ত্র এমন নানা প্রেক্ষাপটে বিপ্লবের সূচনা হয়। দাঙ্গা, ধর্মঘট আর বিক্ষোভের বাস্তবতায় দেশ ছেড়ে পালাতে হয় শাহ ও তার পরিবারকে। তবে তার অস্ত্র কেনা, সামরিক প্রশিক্ষণ- এমন নানা পদক্ষেপের কারণে ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের সময় ইরানের বাহিনী ছিল সে অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী।

বর্তমান সক্ষমতার কথা : ইসরায়েলের হামলায় ইরানের প্রায় ২০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। যা অনেক কম সময়ে আঘাত হানতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এগুলো ঠেকানো কিছুটা কঠিন। কারণ এর গতি। এপ্রিল মাসে ইসরায়েলে ইরান যে হামলা করেছিল, সে তুলনায় এটি বড় পার্থক্যের জায়গা। আগেকার হামলায় ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোনের মতো অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। যেখানে ড্রোন ইসরায়েলে পৌঁছাতে ছয়-সাত ঘণ্টা সময় নেয়। সে তুলনায় এবারের হামলায় হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের দাবি করেছে ইরান। যা ইসরায়েল পৌঁছাতে গড়পড়তা দশ মিনিটের মতো সময় লাগে। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের মতো দূরত্ব এত কম সময়ে পাড়ি দেওয়ায় আগের তুলনায় বেশি আঘাত হানতে পেরেছে। শুধু ক্ষেপণাস্ত্রের দিকে দেখলেও ইরানের স্বল্প ও দূরপাল্লার বিভিন্ন ধরনের মিসাইল রয়েছে। যেমন- শাহাব-৩ দুই হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত পাড়ি দিতে সক্ষম। অর্থাৎ ইসরায়েল পার করে মিশর, অন্যদিকে ইউরোপ, রাশিয়া, ভারত বা চীন পর্যন্তও যেতে পারে সে ক্ষেপণাস্ত্র।

সামরিক শক্তির উৎস : ইরানের অস্ত্র সরঞ্জামের বড় যোগানদাতা রাশিয়া হলেও ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকেই নিজেদের তৈরি ড্রোন দিয়েছে ইরান। অনেকে বলেন, ইরান যদি একবার কিছু একটা দেখার সুযোগ পায় এবং মনে করে তাদের জন্য এটা ভালো হতে পারে, তাহলে সেটা তারা বানিয়ে ফেলতে পারে। কয়েক বছর আগে আমেরিকার ড্রোন ভূপাতিত করার পর তারা ড্রোন বানাতে থাকে। এখন ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি তাদের প্রতিরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ড্রোন। তবে ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ মাধ্যম আইএসএনএ-এর প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স আরও বেশ কিছু দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের তথ্য উল্লেখ করেছে। যেমন- হাজ কাসেম ১৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে, খেইবার ২০০০ কিলোমিটার এবং সিজ্জিল ২৫০০ কিলোমিটার, যেটি ঘণ্টায় ১৭ হাজার কিলোমিটারের বেশি গতিতে ছুটতে সক্ষম। মধ্যপ্রাচ্যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতা ইরানের সবচেয়ে বেশি বলে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র। বহু ধরনের মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্রের বহর ছাড়াও অনেক ধরনের অস্ত্রসম্ভার রয়েছে ইরানের। সেনাবাহিনীর রয়েছে অনেক ধরনের বন্দুক, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান, রকেট লঞ্চারের মতো অস্ত্র। নৌবাহিনীর রয়েছে অনেক ধরনের ছোট-বড় রণতরী, নেভাল মাইন বা বিস্ফোরক, ডুবোজাহাজ, হেলিকপ্টারবাহী তরী এবং টহল জাহাজ। বিমান বাহিনীর আছে হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমান ও বহু ধরনের ড্রোন। সাইবার শক্তিও যথেষ্ট উন্নত করেছে ইরান।

সক্ষমতার পরিসংখ্যান : গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার-এর তথ্য অনুযায়ী সামরিক সক্ষমতায় ১৪৫টি দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান ১৪ তম। যা ইসরায়েলের (১৭-তম) চেয়েও এগিয়ে। তাদের হিসেবে ইরানের ৫৫১টি সামরিক বিমান, ১২৯টি হেলিকপ্টার, ৬৫৭৬৫টি সাঁজোয়া যান, ১৯৯৬টি ট্যাংক, ১০১টি যুদ্ধজাহাজ ও ১৯টি ডুবোজাহাজ রয়েছে। তবে ইরানের অস্ত্র নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সেখানেও পাওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ সেখানে ইরানের নৌবাহিনীতে কোনো আকাশযান বা হেলিকপ্টার বহন করার সক্ষমতা নেই বলা হয়। যদিও ২০২১ সালে ইরানের সামরিক মহড়ার প্রকাশিত ছবিতে মাকরান নামে একটি হেলিকপ্টারবাহী জাহাজ দেখা যায়। নিজস্ব অস্ত্র সমৃদ্ধ করতে ইরান বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যন্ত্রাংশ চোরাচালান করে নিয়ে আসে। এ ছাড়া রাশিয়া তো আছেই, চীন ও উত্তর কোরিয়ার ওপরও কিছুটা নির্ভর করে তারা। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ২০২৪ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী শুধু ২০২৩ সালেই ইরান ১০.৩ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ এক হাজার কোটি ডলারের বেশি অস্ত্রের পেছনে খরচ করেছে। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের হিসেবে বছরে ৯৯৫ কোটি ডলার বাজেট বরাদ্দ করা হয় সামরিক খাতে।

এত অর্থ আসে যেভাবে : ইরানের আর্থিক সামর্থ্যরে পেছনে সবচেয়ে বড় যে দিক কাজ করে, সেটি মূলত এর প্রাকৃতিক সম্পদ। যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালেও বিশ্বে গ্যাসের দ্বিতীয় ও তেলের তৃতীয় বৃহত্তম মজুদ ছিল ইরানের। তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদে যথেষ্ট সমৃদ্ধ ইরান। এ ছাড়া ইরান লাগোয়া হরমুজপ্রণালি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ৩৪ কিলোমিটার প্রশস্ত এ অংশ দিয়ে বিশ্বের ২১ শতাংশ তেলের সরবরাহ হয়। মজার বিষয় হলো, ইরানের জ্বালানি কেন্দ্র করে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা থাকলেও খোদ আমেরিকাও তাদের জ্বালানি কেনে। মাঝে ১০ বছর পুরোপুরি বন্ধ থাকলেও গত চার বছরে কিছু তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য কিনেছে তারা, যেটা প্রকাশ করেছে আমেরিকাই। জ্বালানি তো বটেই, এর বাইরেও নানা ধরনের পণ্য রপ্তানি করে ইরান। বিশ্বে বাণিজ্যে খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে ইরানের আপেল, গম, যব, কমলা, আখ, আলু, পোল্ট্রি বা সবজির মতো পণ্য রয়েছে। এ ছাড়া অস্ত্র, সিমেন্ট, রাসায়নিক পদার্থ, নির্মাণসামগ্রী, সার, ধাতব পণ্য, টেক্সটাইলের মতো অনেক ধরনের পণ্য রয়েছে। বড় যুদ্ধ বাঁধলে সেসব খাতে বিশ্ববাজারে একটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে তারা। বাংলাদেশেও ইরানের আতর, রত্নপাথর বা জাফরানের মতো পণ্য কিনতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া পারস্য সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস ইরানের পণ্যকে বিশ্বব্যাপী আলাদা একটা নামডাকের জায়গা দিয়েছে। আনঅফিসিয়াল বাণিজ্যের মাধ্যমে বার্টার, হুন্ডি, ক্রিপ্টোকারেন্সির মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক বাজারও ধরে রেখেছে ইরান। যেখানে বড় ক্রেতা হিসেবে আফগানিস্তান, সিরিয়া, তুরস্ক, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশ রয়েছে। ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানও রয়েছে। যেটা এশিয়ার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য উপসাগর এবং ইউরোপের সংযোগ তৈরি করে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত