
রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ একসময় ছিল বড় মাছের ভাণ্ডার। রুই, কাতলা, মৃগেল, বোয়াল নাম শুনলেই জেলেদের মুখে হাসি ফুটত। কিন্তু এখন সেই হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে। বড় মাছের দেখা মিলছে কম, আর জেলেদের জাল ভরছে মূলত কাচকি আর চাপিলা দিয়ে। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) রাঙামাটি অবতরণ ঘাটে প্রতিদিন যে মাছ ওঠে, তার প্রায় পুরোটাই এই দুই ছোট প্রজাতির। স্বাদে অনন্য হলেও এগুলো মূলত বড় মাছের খাবার। অথচ এখন উল্টো ছবিই দেখা যাচ্ছে বড় মাছ নেই, ছোট মাছই বাজার দখল করছে।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০২৪-২৫ মৌসুমে হ্রদ থেকে ৬ হাজার টন কাচকি ও চাপিলা আহরণ হয়েছে, রাজস্ব আয় ১২ কোটি টাকা। এর আগের মৌসুমে ছিল ৬,১৭৭ টন (আয় প্রায় সাড়ে ১১ কোটি), আর ২০২২-২৪ মৌসুমে ৬,৪৫৫ টন (আয় প্রায় ১২ কোটি)। মোট মাছ আহরণের ৮০ শতাংশই ছোট মাছ, আর সরকারের রাজস্বের ৯৫ শতাংশ আসে এই দুই প্রজাতি থেকে। তবে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অধীরচন্দ্র দাস মনে করেন, এই পরিসংখ্যান খুশির নয় ‘কাচকি ও চাপিলা হ্রদে ছেড়ে দেওয়া হয় বড় মাছের খাদ্য হিসেবে। কিন্তু বড় মাছ কমে যাওয়ায় এগুলোর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।’ তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ মৌসুমে মোট ১৭ হাজার ৫৬৭ মেট্রিক টন মাছ আহরিত হলেও বড় মাছের পরিমাণ ছিল নগণ্য। এরমধ্যে রুই ১৪ টন, কাতলা ২০, মৃগেল ৫, কালিবাউস ১৩ টন।
বড় মাছ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন- হ্রদ ভরাট হয়ে যাওয়া, নির্বিচারে মা মাছ ধরা, অপরিণত মাছ শিকার। তার মতে, নাব্যতা বৃদ্ধি, ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা এবং হ্রদের সামগ্রিক সংস্কার ছাড়া পরিস্থিতি বদলাবে না। কাপ্তাই হ্রদে মাছের কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনার জন্য প্রতিবছর টানা তিন মাস মাছ শিকার বন্ধ থাকে। বিশেষ করে কার্প জাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেলসহ) প্রজনন ও বৃদ্ধির জন্য নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। যেমন, নির্দিষ্ট মৌসুমে ডিম ছাড়ার ব্যবস্থা, প্রজনন মৌসুমে জাল ফেলার উপর নিষেধাজ্ঞা এবং মৎস্য বিভাগের নিয়মিত তদারকি।
তবুও আশঙ্কাজনকভাবে হ্রদে বড় মাছের উৎপাদন ক্রমেই কমে আসছে। স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ, প্রজনন মৌসুমে অবৈধভাবে জাল ফেলা, ছোট মাছ ধরার প্রবণতা এবং হ্রদের পানির মানের অবনতি এর অন্যতম কারণ। অনেক সময় নিয়ম না মানায় প্রজননকালীন মাছ ও পোনা নষ্ট হয়ে যায়, যার প্রভাব পড়ছে পরবর্তী মৌসুমের উৎপাদনেও। স্থানীয় মৎস্যজীবী সংগঠনগুলো বলছে, নিয়মের কঠোর প্রয়োগ, অবৈধ জাল ব্যবহারের বন্ধ এবং হ্রদের বাস্তুসংস্থান রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে বড় মাছের অভাব আরও প্রকট হয়ে উঠবে। এদিকে মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাপ্তাই হ্রদ থেকে বর্তমানে আহরিত মাছের ৯০ শতাংশই ছোট মাছ। শুধু নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার; মৎস্য পরিবহন ও প্রক্রিয়াকরণসহ মোট ৪০ হাজারের বেশি মানুষ এই খাতের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কাপ্তাই হ্রদের জেলে জলদাশ আফসোস করে বলেন, আগে বড় মাছ পেতাম, দামও ভালো ছিল। এখন কাচকি-চাপিলায় জাল ভরে, কিন্তু বড় মাছের স্বপ্নও যেন ছোট হয়ে গেছে।