
চট্টগ্রামে প্রকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হিসবে পরিচিত হালদা নদীতে প্রতিদিন শত শত টন বিষাক্ত বর্জ্য এসে পড়ছে। এই সব বর্জ্যগুলো নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খাল উপখাল হয়ে হালদা নদীতে এসে মিশে যাচ্ছে। এতে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে হালদা নদী। নদীর পাড়ের মানুষের অভিযোগ নদী ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ রক্ষায় যাদের ওপর দায়িত্ব রয়েছে তাদের উদাসীনতায় বিশেষায়িত এই নদীটি এখন দূষণের কবলে পড়ে মরতে বসেছে। নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতে এশিয়ার বৃহত্তর প্রাকৃতিক এই মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রে গত কয়েক বছর থেকে একের পর এক মা মাছ, ডলফিন মরে ভেসে উঠছে।
নদীর গবেষকরা ও পরিবেশবিদরা দূষণ বন্ধের উদ্বেগ জানিয়ে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনী ব্যবস্থা নেওয়া দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের মতে নানা উৎস থেকে নদী-খাল আর নালা নর্দমায় বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এসব দূষিত বর্জ্য পানিতে পঁচে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খাল উপখাল হয়ে নদীতে এসে পড়ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে হালদার জীববৈচিত্র হুমকির মধ্যে আছে। উদ্বেগজনক হারে মাছ, ডলফিন মরতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি হালদা নদীর সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি খালের পাড় ঘুরে দেখা গেছে দুই পাড়ে রয়েছে সারি সারি মুরগির খামার। এসব খামারের সৃষ্ট মুরগির বিষ্টা প্রতিদিন ফেলা হচ্ছে খালের পানিতে। খালে সদ্য নিক্ষিপ্ত বিষ্টা পানিতে পড়ে রাসায়নিক ক্রিয়ায় পানির মধ্যে ধুয়ার সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। কোনো কোনো স্থানে দুগন্ধে এলাকার পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছে। বিষ্টা ফেলার কারণে পানি বিষাক্ত হয়ে কালো চিকচিকে রং ধারণ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন শহর, বন্দর, গ্রাম সবখান থেকে নানা বর্জ্য নদীতে পড়ছে। অক্সিজেন, বালুচড়া, খন্দকিয়াসহ হাটহাজারীর বিভিন্ন এলাকায় থাকা ছোট ছোট শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য বামনশাহী, খন্দকিয়া, কাটাখালী, মাদারী খালসহ উপখাল হয়ে এসে পড়ছে, বুড়িশ্চর, মোহরা, মাদার্শা, মদুনাঘাট এলাকায় নদীর সংযোগ হয়ে। সরেজমিনে দেখা যায় বামনশাহী ও কাটাখালী খালে বর্জ্য পড়ে থাকার ভয়াবহতার চিত্র। নগরীর অন্যান্য আবাসিক এলাকার পাশ দিয়ে প্রবাহমান এই উপখালের সঙ্গে যুক্ত আছে নানা দিক থেকে বহু নালা নর্দমা। এই পথে পঁচা বিষাক্ত বর্জ্য এসে জমা হচ্ছে খন্দকিয়া খালে। এই খালের পঁচা বিষাক্ত পানি পড়ছে হালদা নদীতে।
পরিবেশ সচেতন সংগঠক নাছির উদ্দীন তালুকদার এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রবাহমান খালগুলোর চিত্র দেখার মতো নয়, কালো চিকচিকে পঁচা পানিতে প্রতিনিয়ত মশা মাছির বিস্তার ঘটছে। পঁচা পানির দুগন্ধে আশপাশে মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে যা উদ্বেগ জনক। ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে হাটহাজারী উপজেলার কাটাখালী খালে মুরগির খামারের সৃষ্ট বর্জ্য ফেলার হয়েছে। এই খালের দুই পাড়ে রয়েছে বহু হাঁস মুরগির খামার। এখানকার সারি সারি খামারে সৃষ্ট বর্জ্য ফেলার একমাত্র ভরসা হিসাবে নিয়েছে কাটাখালী খালকে। হালদা পাড়ের জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন বলেছেন বাপ দাদার আমল থেকে তারা খালের মাছ ধরে জীবন নির্বাহ করে আসছেন। খাওয়া নাওয়ার উৎস ছিল খাল নদীর পানি। তাদের অভিযোগ নদী খাল এখন বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। খালগুলোতে এখন কোনো মাছ নেই। খালের পানিতে দেখা যায় পানি বাহিত কোনো পোকা। পানিতে পা পড়লে সারা শরীরে চুলকানি শুরু হয়।
মাছের মা খ্যাত হালদা নদীর এমন দশা নিয়ে কথা বললে হালদা বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন হালদার দূষণ নিয়ে আমরা বহু বছর থেকে কথা বলে আসছি। দূষণ প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে সুপারিশ করেছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলতা পেয়ে আসলেও এখনও এই বিশেষায়িত নদীটিকে দূষণের কবল থেকে মুক্ত করতে পারিনি। আমাদের পরিদর্শনের অভিজ্ঞতায় দূষণের স্পটগুলো চিহ্নিত করে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধও করি। কিন্তু এতে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না দেখলে আমাদেরকে হতাশই হতে হয়। হালদা দূষণ বিষয়ে কথা বললে চট্টগ্রাম মেট্রো এলাকার পরিবেশ অধিদপ্তরে পরিচালক সোনিয়া সুলতান বলেন আমরা দূষণ এলাকায় পরিদর্শন করে কিছু ব্যক্তিকে পরিবেশ দূষণ করার অপরাধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। অনন্যা আবাসিক এলাকাটি সিটি কর্পোরেশনের অন্তভুক্ত হওয়ার কারণে বিষয়টি সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানিয়েছি।