ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শতবর্ষের ঐতিহ্য চট্টগ্রামের হাতির বাংলো

শতবর্ষের ঐতিহ্য চট্টগ্রামের হাতির বাংলো

পাহাড়, পর্বত, বিস্তীর্ণ জলরাশি কি নেই বন্দর নগরী চট্টগ্রামে? বন্দর নগরীর বর্তমান রূপে আসার আগে কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে বহু ইতিহাস ঐতিহ্যের। তেমনই এক ঐতিহ্যের দারুণ নিদর্শন নগরীর লালখান বাজারের কাছেই অবস্থিত ‘হাতির বাংলো’। যা দেখে দেশ-বিদেশের পর্যটক, শিক্ষার্থী, ইউটিউবার, কনটেন্ট ক্রিয়েটরসহ নানা বয়সী মানুষের চোখেমুখে দেখা দেয় খুশির ঝিলিক। ছবি ভিডিও, সেলফি তুলে নিমিষেই ছড়িয়ে দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। এতে করে বাংলোটি নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে পর্যটকসহ নেটিজেনদের মধ্যে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে জঙ্গলে বিশাল একটি হাতি তেড়ে আসছে! ছায়াঘেরা, পাখি ডাকা, গা ছম ছম করা পরিবেশে তৈরি হাতির বাংলো এটি। শতবর্ষী বাংলোটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, বাংলাদেশ রেলওয়ের ইতিহাসের অংশ। ‘ফেরো’ সিমেন্টের অনন্য স্থাপত্যশৈলী, স্থানীয় লোককথা এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় হাতির বাংলো ক্রমে হয়ে উঠেছে উন্মুক্ত দর্শনীয় স্থান।

চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে লালখান বাজারের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন ও লেডিস ক্লাবের দক্ষিণ পাশে কয়েক মিনিট হাঁটলেই পাহাড় চূড়ায় বাংলোটি চোখে পড়ে। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। আঠারো শতকের শেষদিকে চট্টগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। তখন রেলওয়ে কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্যই বাংলোটি নির্মাণ করেন প্রকৌশলী ব্রাউনজার। হাতির উদ্যত শুঁড়, চোখ, পিঠ মিলে ব্রিটিশ স্থাপত্যের সঙ্গে স্থানীয় শৈলীর এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে। এর লাল ইটের দেয়াল, বড় বড় বারান্দা, উঁচু ছাদ এবং প্রশস্ত ঘরগুলো অটুট। বাংলোটির সামনে ও পেছনের অংশ মিলিয়ে মোট ১২টি গোল আকৃতির জানালা আছে। ডুপ্লেক্স এই ভবনের নিচতলায় ৪টি ও দোতলায় একটি শয়নকক্ষ আছে বর্তমানে। হাতির বাংলো এখন পড়ে আছে অনেকটা জীর্ণশীর্ণ অবস্থায়। ভবনের দেয়ালজুড়ে পড়েছে শেওলা, খসে পড়তে শুরু করেছে পলেস্তারা। কিছুদিন আগেও মানুষের বসবাস ছিল এ বাংলোতে। এখন তালাবদ্ধ। এতেই আতঙ্ক ঐতিহ্যপ্রেমীদের। তাদের দাবি, সংস্কার ও সংরক্ষণ হোক স্থাপনাটি।

বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের ডেপুটি চেয়ারম্যান আদর ইউসুফ জানান, বাংলোটি নির্মিত হয়েছে হাতির আদলে, যা দেশের স্থাপত্য ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। বাহ্যিক কাঠামোটি ত্রিমাত্রিকভাবে হাতির মতোই মাথা, শুঁড়, কানের পরিণত অংশ, শরীরের বর্ধিত কায়া ইত্যাদি রূপে গঠিত। ভবনটির মূল কাঠামো নির্মিত হয়েছে ইট ও পাথরের গাঁথুনির ওপর। তবে এর হাতির রূপ ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহৃত হয়েছে ফেরো সিমেন্ট, যা উনিশ শতকে উন্নত নির্মাণপ্রযুক্তির নির্দেশক। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত কাঠ ব্যবহার করে নির্মিত দরজা ও জানালাগুলোতে কারিগরি দক্ষতার পরিচয় রয়েছে। প্রচলিত ঔপনিবেশিক বাংলোর গঠন থেকে এটি অনেকটাই আলাদা। স্থাপত্যশৈলীতে কোনো সুপরিকল্পিত আদর্শ অনুসরণ না করলেও একে ঘিরে আছে একধরনের আভিজাত্য ও প্রকৌশলগত সৃজনশীলতা। চট্টগ্রামের মানুষের সঙ্গে হাতির সম্পর্ক প্রাচীনকাল থেকে। এ জনপদে হাতিকে মামা সম্বোধনে অভ্যস্ত। পাহাড়ি এলাকায় বড় বড় গাছের টুকরা নামানো হতো হাতির সাহায্যে। হাতি পোষা হতো সরকারি ও জমিদারের ব্যবস্থাপনায়। সার্কাসের হাতি তো ছিলই।

চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রেনের সাহায্যে একটি হাতি জাহাজে তোলার ছবি রীতিমতো বিখ্যাত। হাতি চলাচলের পথকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের সময়। হাতির কঙ্কাল সংরক্ষিত আছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে। খাবারের সন্ধানে এখনও আনোয়ারা, বাঁশখালী, পার্বত্য জেলায় বন্যহাতি লোকালয়ে নেমে আসে, ফসল, ঘরবাড়ি এমনকি মানুষের জীবনও ধ্বংস করছে। শিকারির হাতেও মারা পড়ছে হাতি। এসব বিষয়ের ছবি, ভিডিও, হাতির কঙ্কাল, মাটি ও সিমেন্টের হাতি ‘হাতির বাংলো’-য় রাখা যেত বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা। ঘুরতে আসা দর্শনার্থী মো. সামিউল ইসলাম বলেন, হাতির বাংলো নিয়ে মানুষ কমই জানে। সরকারের আরেকটু উদ্যোগী হওয়া উচিত। এখানে হাতি বিষয়ক অডিও ভিজুয়াল সংগ্রহশালা, একটি ছোট শিশুপার্ক, টি-স্টল, বাগান করা যায়। যা বাংলোটির শোভাবর্ধনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

এখন যেমন পাহাড় কেটে, গাছপাল কেটে ভবন নির্মাণ করা হয়, হাতির বাংলো নির্মাণে তার কিছুই হয়নি। চারপাশের সৌন্দর্যকে এতটুকুও ব্যাহত করা হয়নি, বরং প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে এই স্থাপনা। এ বাংলোতে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে পাহাড়ি এলাকা। সারি সারি নানা প্রজাতির গাছগাছালি। সবসময় নীরব-নিস্তব্ধতা। পাখির কিচিরমিচির শব্দ প্রাঙ্গণজুড়ে। নগরজীবনের যে নাগরিক কোলাহল, তা এখানে অনুপস্থিত। এমন শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশে নির্মাণ করা হাতির বাংলোতে একসময় থাকতেন রেলের পদস্থ কর্মকর্তারা। তবে কালের বিবর্তনে দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় স্থাপত্যের এই বাড়ি এখন প্রায় পরিত্যক্ত। ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে আছে কোনো রকমে। একসময় যেখানে রেলের পদস্থ কর্মকর্তারা থাকতেন, বর্তমানে সেখানে তাদের কেউ থাকেন না। বাংলোর জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে বিমুখ হয়েছেন তারা। একসময়ের জৌলুশে ভরা এই বাংলো বাড়ি এখন পুরোটাই মলিন ও বিবর্ণ। পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরেছে। ভবনের গায়ে জন্মেছে নানা ধরনের আগাছা। কর্মকর্তারা যাওয়ার পর বাংলোর নিচতলায় দুটি আলাদা বড় কক্ষের একটিতে থাকতেন হাতির বাংলোর তত্ত্বাবধায়ক জাকের হোসেন। অন্যটিতে জাকের হোসেনের বন্ধু দোকানি মো. মিজান। সম্প্রতি তারাও এই বাংলো ছেড়ে দিয়েছেন।

১৯৯৪ সাল থেকে হাতির বাংলোর তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করে আসছেন জাকের হোসেন। তিনি বলেন- এই বাংলো কবে নির্মিত হয়েছিল, তা সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। তবে স্যারদের কাছে শুনেছি, চট্টগ্রাম-ফেনী রেললাইন করার সময় প্রকৌশলীদের থাকার জন্য এখানে হাতির বাংলো নির্মাণ করা হয়। হাতির বাংলোটি অফিসার্স মেস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রেলওয়ের বিসিএস ক্যাডার ও কর্মকর্তারা এখানে থাকতেন।

এমনও সময় গিয়েছে যে, তার দায়িত্বপালনের সময় একসঙ্গে ৮-১০ জন কর্মকর্তাকে এই বাংলোতে থাকতে দেখেছেন। তবে ধীরে ধীরে হাতির বাংলোতে থাকার প্রতি কর্মকর্তাদের আকর্ষণ কমে যায়। কেননা রেলওয়ে নতুন ভবন করেছে, সেখানেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন কর্মকর্তারা। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ পর্যন্ত জাহেদ হোসেন নামের এক কর্মকর্তা থাকতেন। পরে তাকে ঢাকায় বদলি করা হলে আর কোনো কর্মকর্তা এখানে আসেননি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত