
বন্দর নগরী চট্টগ্রামে দিন দিন জনসংখ্যা বাড়লেও সেই তুলনায় বাড়েনি প্রয়োজনীয় আবাসন ব্যবস্থা। বিগত ১৭ বছরে জনবহুল এ নগরীতে এরমধ্যে নতুন করে কোনো আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠেনি। নতুন আবাসিক প্রকল্প গড়ে না উঠায় বহু নগরবিদ এটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এর ব্যার্থতা হিসেবে দেখছেন। এদিকে, নগরীর বাসিন্দারা বলছেন, দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আবাসন সংকট বাড়ছে। যার প্রধান কারণ দ্রুত নগরায়ণ এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন। কর্মসংস্থানের সুযোগ ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ চট্টগ্রামে আসছে। কিন্তু আবাসন খাতের চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এর ফলে জমির উচ্চমূল্য, নতুন প্রকল্পের অভাব এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর মতো সমস্যাগুলো প্রকট হচ্ছে। ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠা পায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠার ৬৬ বছরে গড়ে তুলেছে ১২টি আবাসন প্রকল্প।
এসব প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬০৬৪টি। এরমধ্যে দুইটি আবাসিক প্রকল্পে নির্মিত হয়নি একটি বাড়িও। আরও কয়েকটি প্রকল্পে অধিকাংশরাই বাড়ি নির্মাণ করেননি প্লট মালিকরা। ফলে বছরের পর বছর বরাদ্দের প্লট খালি থাকায় সংস্থাটির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। প্লট মালিকদের দাবি, দীর্ঘদিন পরও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত হয়নি বরাদ্দের অনেক আবাসিক এলাকায়। শুধুমাত্র, প্লট বরাদ্দ দিয়ে দায় সেরেছে সিডিএ।
অন্যদিকে অনন্যা আবাসিক প্রকল্প এলাকায় প্লট বরাদ্দে সিডিএর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ আছে। বলা হচ্ছে- নিয়ম না মেনে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতাসহ একাধিক প্রভাবশালীকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর সিডিএ চট্টগ্রাম নগরে ১২টি আবাসিক প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পগুলো হলো- ১৯৬৩ সালে কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকা দিয়ে সিডিএর আবাসন কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৫ সালে আগ্রাবাদ, ১৯৭৩ সালে চান্দগাঁও, ১৯৭৭ সালে কর্ণেলহাট, ১৯৮৫ সালে সলিমপুর, ১৯৯২ সালে কর্ণফুলী, ২০০০ সালে চন্দ্রিমা, ২০০২ সালে চান্দগাঁও দ্বিতীয় পর্যায়, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে কল্পলোক প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় এবং ২০০৮ সালে অনন্যা আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়।
২০০৯ সালে ষোলশহর পুনর্বাসন এলাকায় ৪৮টি প্লট ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের দেওয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিডিএর নেওয়া ১২ আবাসিক প্রকল্পের মধ্যে এখনও বেশ কয়েকটি প্রকল্পে বাড়ি নির্মাণ করেননি প্লট মালিকরা। এরমধ্যে তিন দশক আগে ১৯৯২ সালে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে মইজ্জারটেক এলাকায় কর্ণফুলী আবাসিক প্রকল্প গ্রহণ করে সিডিএ। ১৯৯৪ সালে এই প্রকল্পে ৫১৫ জনকে ৪৮৯টি প্লট বরাদ্দ দেয়। তবে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার প্রায় ৩০ বছর পরও প্রকল্প এলাকায় ভবন নির্মাণ দূরে থাক, কোনো নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি। শুধু কর্ণফুলী আবাসিক নয়, সিডিএর এ রকম আরও অনেক আবাসন প্রকল্প এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এরমধ্যে রয়েছে অনন্যা আবাসিক (১-২ প্রকল্প)।
অন্যদিকে সলিমপুর, কল্পলোক আবাসিক প্রকল্পেও নির্মিত হয়নি অর্ধেক বাড়িও। বরাদ্দ পাওয়া প্লট মালিকরা জানান, এসব প্রকল্প এলাকায় সীমানা প্রাচীর নেই। মূলত পানি এবং বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এখানে আবাসিক স্থাপনা গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে, ১৯৮৫ সালে সলিমপুর আবাসিক প্রকল্প হাতে নেয় সিডিএ। সেখানে মোট প্লটের সংখ্যা এক হাজার ২৯টি। এখানে অধিকাংশ বাড়ি করেননি প্লট মালিকরা। ২০০৬ ও ২০০৭ সালে বাকলিয়া এলাকায় গড়ে তোলা হয় কল্পলোক আবাসিক (প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়)। ২৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এক হাজার ৭০০টি প্লট নিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়।
কিন্তু প্রকল্পটিতে কিছু আবাসন নির্মাণ হলেও এখনও আধুনিকায়ন হয়নি সড়ক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ২০০৮ সালে প্রায় ৩৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় দুটি ইউনিটে প্রায় ১,৭০০ প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলেও এখনও আবাসন গড়ে ওঠেনি। সিডিএর কর্মকর্তারা জানান, নগরের পতেঙ্গা, বায়েজিদ ও হাটহাজারী এলাকায় আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে সিডিএ। এসব প্রকল্প এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এরমধ্যে ২০১৪ সালে অনন্যা আবাসিক প্রকল্প নামে দ্বিতীয় পর্যায় নামে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এটি পাঁচলাইশ, কুয়াইশ ও বাথুয়া মৌজার ৪১৮ দশমিক ৭৩ একর জমির ওপর করার কথা ছিল। ব্যয় ধরা হয় ২,৮৩২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। যা পরবর্তীতে একনেক সভায়ও পাস হয়। কিন্তু সিডিএ কর্মকর্তারা হিসাব করে দেখেন, এসব অনুন্নত এলাকায় যেখানে রাস্তাঘাট নেই, চলাচলের পথও নেই। এমন একটি জায়গায় প্রতি কাঠা ভূমি যদি ২০ লাখ টাকার বেশি দামে হুকুম দখল করতে হয় তাহলে প্লট বিক্রি করা অসম্ভব।
কাঠা প্রতি ২০ লাখ টাকায় হুকুম দখল করার পর ভূমি উন্নয়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনা করে প্লট তৈরি করার ক্ষেত্রে কাঠা প্রতি আরও ৮-১০ লাখ টাকা খরচ যুক্ত হয়। রাস্তাঘাট, খেলার মাঠসহ আবাসিক এলাকায় নাগরিক সুবিধাগুলো তৈরি করতে প্রচুর খরচ। এক্ষেত্রে কাঠা প্রতি ৩০-৩৫ লাখ টাকা খরচ করে প্রতি কাঠা ৪০ লাখ টাকা দামে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করা কঠিন হবে।
এ কারণে এই আবাসিক প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। অনন্যা আবাসিক প্রকল্পের প্লট মালিক মো. আনসার উল ইসলাম জানান জানান, প্লট বরাদ্দ নেওয়ার দীর্ঘ বছরেও এখানে নাগরিক সুবিধা গড়ে ওঠেনি। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। ভবন করতে অতিরিক্ত পাইলিং করতে হয় এমন একটি গুজব ছিল। যে কারণে প্লট মালিকরা এতদিন বাড়ি নির্মাণে এগিয়ে আসেননি। বর্তমানে এখানে বেসরকারি এভারকেয়ার হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে।
এরপর থেকে প্লট মালিকরা বাড়ি নির্মাণে উৎসাহ পাচ্ছেন। কেউ কেউ বাড়ির নকশার অনুমোদন নিয়েছেন। আরও অনেকে অনুমোদনের জন্য নকশা জমা দিয়েছেন। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জানান, প্রতিষ্ঠার পর থেকে সিডিএ ১২টি আবাসিক প্রকল্প গড়ে তুলেছে। যেসব আবাসিকে বাড়ি নির্মাণ হয়নি সেগুলোতে নির্মাণের জন্য তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য প্রকল্প নেওয়ার বিষয়টিও আমাদের মাথায় আছে। সেজন্য সরকারি জমি খোঁজা হচ্ছে। বাকি প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে আবাসন সংকট কেটে যাবে।