ঢাকা ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৮ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঐতিহাসিক

মসজিদের শহর ঢাকা

দিদার শফিক
মসজিদের শহর ঢাকা

ঢাকা মসজিদের শহর। ঢাকায় প্রচুর সংখ্যক মসজিদ থাকায় ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর। ঐতিহাসিকভাবে জানা যায় যে, বাদশা বাবরের মোগল আমল থেকেই ঢাকা মসজিদের শহরে পরিণত হয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯ শতকে পাকিস্তান আমলে মসজিদ নির্মাণ আগের চেয়ে আরো বেড়ে যায়। ঢাকায় সাত হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক মসজিদ আছে এবং নব্য নির্মিত মসজিদও আছে প্রচুর। তবে ছোট বড় মসজিদের ভিড়ে এখনো সৌন্দর্যের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে প্রাচীন মসজিদগুলো। এ নিবন্ধে ঢাকার প্রাচীন কয়েকটি মসজিদের পরিচয় তুলে ধরা হলো:

বিনত বিবির মসজিদ : বিনত বিবির মসজিদ বাংলাদেশের ঢাকা শহরের পুরান ঢাকা এলাকায় অবস্থিত। এটি একটি মধ্যযুগীয় মসজিদ। নারিন্দা পুলের উত্তর দিকে অবস্থিত এই মসজিদটি ৮৬১ হিজরি সাল মোতাবেক ১৪৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে তার মেয়ে মুসাম্মাত বখত বিনত বিবি এটি নির্মাণ করান। নারিন্দার প্রাচীনতম পুল; হায়াত বেপারির পুল। এর পাশেই এ মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটি চৌকোনাবিশিষ্ট। এতে দুইটি গম্বুজ ও চারটি মিনার আছে। ধারণা করা হয়, এই মসজিদটি ঢাকার সবচেয়ে পুরাতন মুসলিম স্থাপনার নিদর্শন।

চক বাজার শাহী মসজিদ : পুরোনো ঢাকার চকবাজারে অবস্থিত মোগল আমলের মসজিদ এটি। মোগল সুবেদার শায়েস্তা খান ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন। এ মসজিদটিতে রয়েছে তিনটি গম্বুজ আর বিশাল একটি মিনার। মিনারটি মসজিদের সৌন্দর্য বহু গুণে বৃদ্ধি করেছে। কয়েক মাইল দূর থেকেও এ মিনারটি দেখা যায়।

তারা মসজিদ : মোগল স্থাপত্যশিল্পের ঐতিহ্যকে ধারণ করে পুরান ঢাকায় নির্মাণ করা হয়েছে অনেক মসজিদ। তারা মসজিদও মোগল স্থাপত্যশিল্পের আদলে নির্মিত হয়েছে। সতেরো শতকের দিল্লি, লাহোর আর আগ্রায় নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনার আদলে তারা মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদটির অবস্থান পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় ৬/৩ আবুল খয়রাত রোডে। ?পরে ১৯২৬ সালে ঢাকার ব্যবসায়ী আলী জান ব্যাপারী মসজিদটির সংস্কার করেন।

মুসা খান মসজিদ : মুসা খানের মসজিদ বা মুসা খাঁর মসজিদ বাংলাদেশের ঢাকা শহরে অবস্থিত মোগল স্থাপত্যের একটি নিদর্শন। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর শহীদুল্লাহ হল ছাত্রাবাসের নিকটে ও কার্জন হলের পেছনে অবস্থিত। ধারণা করা হয়, এই মসজিদটি ঈসা খাঁর পুত্র মুসা খান নির্মাণ করেছেন। ঢাকা শহরে বিনত বিবির মসজিদের পাশাপাশি এটি প্রাক-মোগল স্থাপত্যের একটি প্রাচীন নিদর্শন।

কর্তালাব খান মসজিদ : কর্তালাব খান মসজিদটি পুরোনো ঢাকার বেগম বাজারে অবস্থিত। এ মসজিদটি বেগম বাজার মসজিদ নামেও পরিচিত। ১৭০১ থেকে ১৭০৪ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছে এটি। তৎকালীন দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খানের নামে নামকরণ করা হয় এ মসজিদটির। মুর্শিদ কুলি খান কর্তালাব খান নামেও পরিচিত ছিলেন।

হাজী শাহবাজ মসজিদ : হাজী শাহাবাজের মসজিদ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের রমনা এলাকায় অবস্থিত। এটি একটি প্রাচীন মসজিদ। মোগল শাসনামলে শাহজাদা আযমের সময়কালে ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মিত হয়। মসজিদটি হাইকোর্টের পেছনে এবং তিন নেতার মাজার এর পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত। এর চত্ত্বরে হাজী শাহবাজের সমাধি অবস্থিত। দৈর্ঘ্যে মসজিদটি ৬৮ ফুট ও প্রস্থে ২৬ ফুট। এতে তিনটি গম্বুজ রয়েছে।

খান মহম্মদ মৃধার মসজিদ : খান মহম্মদ মৃধার মসজিদ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পুরোনো ঢাকা এলাকার আতশখানায় অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। এটি ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে নায়েবে নাযিম ফররুখশিয়ারের শাসনামলে নির্মিত হয়। ঢাকার প্রধান কাজী ইবাদুল্লাহের আদেশে খান মহম্মদ মৃর্ধা এটি নির্মাণ করেন। ১৭০৪ ও ১৭০৫ সালে তিনি নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।

কসাইটুলি মসজিদ : মসজিদটি পুরোনো ঢাকার কসাইটুলির পিকে ঘোষ রোডে অবস্থিত শতবর্ষী একটি মসজিদ। স্থানীয়ভাবে এটি ‘চিনির টুকরা মসজিদ’ নামে পরিচিত। মসজিদের গায়ে চিনামাটির সাদা টুকরাগুলো দেখতে চিনির দানার মতো হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা মসজিদটিকে এই নামে ডাকেন।

হযরত শাহ জালাল দাখিনির মসজিদ : ঢাকার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবনের পাশে তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি পুরোনো মসজিদ এটি। মোগল আমলে নির্মিত হয়েছে এটি। এই মসজিদের ১৮৯০ সালের একটি ছবি পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে, এটি হযরত শাহ জালাল দাখিনির মসজিদ। শাহ জালাল দাখিনী (রহ.) পনেরো শতকের একজন দরবেশ।

তিনি সুলতান ইউসুফ শাহের (১৪৭৪-৮১) শাসনকালে গুজরাট থেকে কয়েকজন শিষ্যসহ পূর্ববঙ্গে আসেন। দাক্ষিণাত্য থেকে আগমন করেন তিনি। তাই ধারণা করা হয়, লোকেরা তাকে দাখিনী বলে অভিহিত করতেন। দাখিনী ঢাকার মতিঝিলে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে ধর্ম প্রচার করতেন। সৎ ও স্পষ্টভাষী হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বমহলে। এ কারণে তিনি একজন সুলতানের মতো জনগণের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ৮৮১ হিজরিতে (১৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) তার কয়েকজন সহচরসহ তাকে হত্যা করা হয়েছিল। তৎকালীন শাসকরা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তাকে হত্যা করিয়েছিলেন। হযরত শাহ জালাল দাখিনির মসজিদকে বর্তমানে দিলকুশা মসজিদ বলা হয়।

গোর-ই-শহীদ মসজিদ : এটি স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার ক্যাম্পাসে অবস্থিত। ধারণা করা হয়, মসজিটি ১৭০০ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে। মসজিদে এতিমখানার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিবাসী ছাত্ররা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন এবং ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন। এ মসজিদে এতিমখানা সংলগ্ন সরকারি কলোনীর বাসিন্দারা এবং এলাকাবাসী নামাজ আদায় করেন। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার তত্ত্বাবধায়নে এ মসজিদটি পরিচালিত হয়।

খাজা আম্বর মসজিদ : ঢাকা শহরের কারওয়ানবাজার এলাকার মোগল সুবেহদার শায়েস্তা খানের প্রধান খোজা, খাজা আম্বর ১৬৮০ খিষ্টাব্দে এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটিতে দুটি শিলালিপি আছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবের উপরে স্থাপিত প্রথম শিলালিপিতে রয়েছে কোরআনের একটি আয়াত। আর কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের উপরে বাইরের দিকে স্থাপিত দ্বিতীয় শিলালিপিতে নির্মাণ সাল উল্লেখ আছে। মসজিদটির নির্মাণশৈলী অত্যন্ত চমৎকার ও দৃষ্টিনন্দন। তিন গম্বুজের এ মসজিদ ভূমি থেকে প্রায় ১২ ফুট (৩.৬৬ মি) উঁচু একটি উত্তোলিত মঞ্চের পশ্চিম অর্ধাংশজুড়ে অবস্থিত। এ ভিত্তিমঞ্চের শীর্ষে রয়েছে বদ্ধ পদ্মণ্ডপাপড়ি নকশার একটি সারি। এর চারকোণে রয়েছে চারটি বিশাল আকৃতির পার্শ্ববুরুজ। অষ্টভুজাকৃতির বুরুজগুলো ভিত্তিমঞ্চের চেয়ে সামান্য একটু উঁচু এবং এগুলোর শীর্ষে রয়েছে ছোট ছোট গম্বুজ। পূর্ব প্রান্তে একটি সিঁড়ি পেরিয়ে পাথরের তৈরি ফ্রেমবিশিষ্ট খিলানযুক্ত একটি তোরণ পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। এ সিঁড়িপথের ডান দিকে খাজা আম্বরের খননকৃত কূপটি ছিল, তবে বর্তমানে এটিকে মাটি ফেলে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ভিত্তিমঞ্চের পূর্বদিকে রয়েছে খাজা আম্বরের সমাধি। আদিতে এখানে শুধু পাথরের তৈরি কবর ফলক দৃশ্যমান ছিল। তবে বর্তমানে এর উপরে ইট দিয়ে একটি ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে।

শায়েস্তা খাঁর মসজিদ : এটি পুরান ঢাকার একটি অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। শায়েস্তা খাঁ যখন প্রথম ঢাকায় সুবেদার হিসেবে এসেছিলেন তখন তিনি এ মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। ঢাকা শহরে শায়েস্তা খাঁ সুবেদার হিসেবে আসার পরে বিভিন্ন ইমারত নির্মাণ করেন। তার নিজে থাকার জন্য মিডফোর্ড এলাকায় ইমারত ও মসজিদ নির্মাণ করেন। শায়েস্তা খাঁর মসজিদ নামের ছোট মসজিদটিও বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষে মিডফোর্ড হাসপাতালের পেছনে অবস্থিত। বিংশ শতকের প্রথম দিকে মসজিদটি পুড়ে গেলে তা আবার পুনঃনির্মাণ করা হয়। (তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, পত্র-পত্রিকা )।

লেখক: ভাইস প্রিন্সিপাল, ঢাকা আইডিয়াল সিটিজেন মাদ্রাসা, মানিকনগর, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত