আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে জাকারিয়া আল রাজি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এক চিকিৎসাবিদ। তিনি আল-কেমি, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও দর্শনশাস্ত্রে যুগান্তকারী অবদান রাখেন। সালফিউরিক এসিড, ইথানল উৎপাদন, বিশোধন, ও চিকিৎসায় এর ব্যবহার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবেও তার ব্যাপক পরিচিত ছিল।
জন্ম ও পড়াশোনার হাতেখড়ি : আল রাজির জন্ম ৮৬৫ সালে। আলবার্জ পর্বতমালার দক্ষিণের ঢালে বিখ্যাত সিল্ক রোডের পাশের রায় শহরে। রায় ইরানের রাজধানী তেহরানের কাস্পিয়ান সাগরের ধার ঘেঁষে অবস্থিত। তার পুরো নাম আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে জাকারিয়া আল রাজি হলেও তিনি আল রাজি নামে সুবিদিত। জন্মস্থানের দিকে লক্ষ্য করে তাকে আল রাজি বলা হয়। ইউরোপে তিনি আল রাজেস নামে পরিচিত।
ছেলেবেলায় প্রখর মেধাবী ছিলেন আল রাজি। জন্মভূমি রায়ে পড়াশোনার হাতেখড়ি। রায়ে অঙ্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন ও দর্শনশাস্ত্রে জ্ঞানার্জন করেন। এখানে লেখাপড়া শেষ করে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভে বাগদাদ চলে যান। সে সময় তার বয়স ২০ বছর। বাগদাদে এসে তিনি গ্রিক চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। এ সময় তিনি ইরানি চিকিৎসাপ্রণালি ও ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। পদার্থবিদ্যায় তার বুৎপত্তির সুনাম তৎকালীন মানুষের মুখে মুখে ছিল। তবে শিক্ষাজীবনের শুরুতে সংগীত ও শিল্পকলায় আগ্রহী ছিলেন তিনি।
চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যাপক : শিক্ষাজীবন শেষে কিছুদিন জুন্দেশাপুর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষানবিশ ছিলেন। এখানে তিনি আলকেমি ও ভেষজতত্ত্বে গভীর গবেষণা করেন। এক সময় স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেন। চিকিৎসক হিসেবে বেশ সুনাম করেন তিনি। বাগদাদে তার জুড়ি ছিল না। তিনি কিছুকাল খলিফা আলমুকতাদিরের প্রধান চিকিৎসক ছিলেন। খলিফার অনুরোধে কয়েক বছর রায়, জুন্দেশাপুর ও বাগদাদের সরকারি হাসপাতালের অধ্যক্ষ পদে কাজ করেন আল রাজি। দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা ছুটে আসত তার কাছে। এরপর রায়-এর গভর্নর মানসুর ইবনে ইসহাক তাকে রায় শহরে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানান এবং রায় হাসপাতালের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন।
বাগদাদ থেকে আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাদিদ তাকে ডাকেন। সেখানে তাকে নতুন একটি হাসপাতালের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আল মুতাদিদের ছেলের শাসনামলে আল রাজি আব্বাসীয় খেলাফতের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল নির্মাণের দায়িত্ব পান। শিক্ষক হিসেবেও আল রাজির খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল বেশ। তার আলোচনা শুনতে দূরের শিক্ষার্থীরা ভিড় জমাত।
বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা : আল রাজির এখানে গরিব মানুষদের চিকিৎসা করতে টাকা লাগত না। তিনি ৪০ বছর মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যান। চিকিৎসক হিসেবে আল রাজি চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে ইবনে সিনার পর তার নামই আসে। অনেক বিশেষজ্ঞ আল রাজিকে মধ্যযুগের সেরা চিকিৎসক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি পেডিয়াট্রিকস, অপথ্যালমোলজি, নিউরোসার্জারি, সংক্রামক রোগসহ চিকিৎসাবিদ্যার অনেক শাখার জনক ছিলেন।
ভাণ্ডারে তার বিবিধ রতন : আল রাজি প্রথম সালফিউরিক এসিড তৈরি করেন। এছাড়া অসংখ্য লবণ, অ্যালাম প্রভৃতি তৈরি করেছেন তিনি। নানারকম রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং যন্ত্রপাতিও উদ্ভাবন করে গেছেন। কেরোসিন ল্যাম্প তার অন্যতম। আল রাজি ধাতুর রূপান্তরে বিশ্বাসী ছিলেন। নবম শতকে তিনি তার বই কিতাব আল আসরারে কেরোসিন উৎপাদনের দুটি পদ্ধতির কথা লিখেন। এর অনেক পরে ১৮৪৬ সালে আবরাহাম গেসনার পিচজাত কয়লা ও তেলশিলা থেকে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে ঝরানো পাতনের সাহায্যে কেরোসিন শোধন করেন। কেরোসিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৮৫৪ সালে।
বহু গ্রন্থ প্রণেতা : আল রাজি প্রায় দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। আর এর অর্ধেকই ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধীয়। প্রায় প্রত্যেক রোগ সম্পর্কেই তিনি ছোট ছোট বই লিখে গেছেন। মানুষের কিডনি ও গল ব্লাডারে কেন পাথর হয়; সে সম্পর্কে তিনি একটি মৌলিক তথ্যপূর্ণ বই লিখেছেন। লাশ কাটার বিষয়েও আলোচনা করেছেন। এই একটি মাত্র কারণে তিনি আজও স্মরণীয় আছেন এবং থাকবেন। এ ব্যাপারে তিনি লিপিবদ্ধ করেন আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ। এতে গুটিবসন্ত ও হাম রোগের লক্ষণের সঠিক বিবরণ ও পার্থক্য লিপিবদ্ধ করেন, যা তার প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। এটি ল্যাটিন ও ইউরোপের সব ভাষায় অনুবাদ হয়। শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষাতেই ৪০ বার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। এছাড়াও লিখেন কিতাবুল মুনসরি ও কিতাব আল মুলুকি।
সব রোগের বিস্তারিত গাইডলাইন : তার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে আল হাবি। এতে সর্বপ্রকার রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বইয়ে ২০টি খণ্ড আছে। আল হাবির নবম খণ্ডটি ইউরোপের প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ষোলশ বছর পর্যন্ত নির্দিষ্ট ছিল। এই বইটিতে তিনি প্রত্যেক রোগ সম্বন্ধে প্রথমে গ্রিক, সিরীয়, আরবি, ইরানি ও ভারতীয় চিকিৎসা প্রণালির বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তারপর নিজের মতামত ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। তার চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে এল হাওয়াই সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। ওই গ্রন্থ লিবার কন্টিনেন্স নামে লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদের পর আল রাজির মতো কোনো মুসলিম মনীষী শিক্ষা ও রেনেসাঁয় তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি।
চক্ষু বিশেষজ্ঞের চোখই জীবন থামিয়ে দিল : ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে আল রাজির চোখে রোগ হয়। রোগের নাম গ্লুকোমা। চোখ সম্পর্কে ওই সময়ে তিনিই বেশি জানতেন। তবে চোখের চিকিৎসা সম্পর্কে তার জানাশোনা ছিল কিনা- তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। ইরানের এক প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক তাকে বললেন, ‘আমি আপনার চোখের চিকিৎসা করব।’ আল রাজি তার কাছে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলুন তো, চোখের রেটিনার স্তর কয়টা?’ চিকিৎসক হা করে তাকিয়ে থাকলেন। মুখে রা নেই। তৎকালে একমাত্র আল রাজিই জানতেন, চোখের ১০টা লেয়ারের কথা! আল রাজি বললেন, ‘যে লোক রেটিনা সম্পর্কে জানে না, তার কাছে আমি চিকিৎসা করাব না।’ তৎকালীন অনেক চিকিৎসক আল রাজির চিকিৎসা করতে চাইলেন। সবাইকে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, ‘রেটিনার লেয়ার কয়টা?’ কেউই উত্তর দিতে পারতেন না।
তার চোখের রোগ আর ভালো হয়নি। এক সময় অন্ধ হয়ে যান। তবে তার অন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে অনেক ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। কেউ বলেন, তিনি অন্ধ হয়ে গেছেন। কেউ বলেন, তাকে অন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অন্ধাবস্থায় ৯২৫ সালে জন্মভূমি ইরানে তিনি ইন্তেকাল করেন। আল রাজির ইন্তেকালের পর প্রখ্যাত মুসলিম মনীষী আল বেরুনি তার জীবনী লিখেন।
আল রাজির নামে ইরানে রাজি ইনস্টিটিউট এবং রাজি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ইরানে প্রতি বছর ২৭ আগস্ট রাজি দিবস পালন করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই মহান ব্যক্তির নামে অনেক হাসপাতাল রয়েছে।
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক