মসজিদের বাহিরটা জরাজীর্ণ। দেয়ালের আস্তরণ খসে পড়েছে বহু আগেই। গম্ভুজের ওপর লকলকিয়ে উঠেছে লতাগুল্ম। শ্যাওলা জমে কালো হয়ে গেছে ওপরের ছাদ। জংলি গাছে বেমানান হয়ে আছে চারপাশ। বহু প্রাচীন এই মসজিদের নাম বখতিয়ারি মসজিদ। রংপুর সদর উপজেলার মাহিগঞ্জের সুইপার কলোনিতে অবস্থিত এটি। কালের সাক্ষী মসজিদটি এখন পরিত্যক্ত।
মসজিদটির আয়তকার : উত্তর-দক্ষিণে ৩২ ফুট লম্বা, প্রস্থে ১৩ ফুট। মাটি থেকে কার্নিশের উচ্চতা দশ ফুট। পূর্ব দিকের দেওয়ালে রয়েছে তিনটি অর্ধবৃত্তাকার খিলানবিশিষ্ট প্রবেশপথ। উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের প্রবেশপথগুলোও একই আকৃতির। উত্তরের প্রবেশপথটি ছাড়া অন্য পথগুলো ইটের গাথুনি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম দেওয়ালে অবতলাকৃতির তিনটি মেহরাব রয়েছে। মূল মেহরাবের ওপর দিকে এখনও চোখে পড়ে আবছা হয়ে যাওয়া ফুলের নকশা। উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের পশ্চিম কোণে দুটো কুলুঙ্গি আছে।
মসজিদের অবকাঠামো : মসজিদের ওপর রয়েছে তিনটি গম্বুজ। বর্গাকৃতির ‘বে’গুলোর কোণগুলো ত্রিকোণাকৃতির পেন্ডেটিভ নকশায় পরিপূর্ণ। চার কোণে চারটি বুরুজও আছে। কলসভিত্তি ও অর্ধ-গোলাকার আকৃতি নিয়ে এগুলো ছাদের প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব স্থাপত্যশৈলী মোগল আমলের নয়, বরং সুলতানি আমলের মসজিদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে অনেক বেশি মিলে। সে ধারণা থেকে বলা যায়, মসজিদটি মোগল আমলেরও আগে নির্মিত।
ইতিহাসের খোঁজে : মসজিদের পূর্ব দিকের মাঝের প্রবেশপথটির ওপর একটি শিলালিপি ছিল। শিলালিপিটি হারিয়ে যাওয়ায় মসজিদের নির্মাণ তারিখ সঠিকভাবে নির্ণয় করা মুশকিল। মসজিদের দক্ষিণে আছে রংপুরের সাবেক চেয়ারম্যান কাজি জুননুন স্থাপিত একটি স্মৃতিফলক। সেটি এতই অস্পষ্ট যে, মসজিদ ও চেয়ারম্যানের নাম ছাড়া আর কিছুই পড়া যায় না। তাই এই মসজিদ সম্পর্কে জানার গ্রহণযোগ্য উৎস হলো, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রংপুরের এরিয়া সদর দফতর থেকে ২০০৮ সালে প্রকাশিত আলোকচিত্রে ইতিহাস : বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর বই। এই বইয়ে ছাপানো আছে মসজিদের ছবি। মসজিদের নির্মাণকাল ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ বলে বইয়ে উল্লেখ আছে। তবে বইটিতে মসজিদের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিকের বিশ্লেষণ দেওয়া হয়নি।
ইতিহাস বলে, ১২০৪ সালে বঙ্গ বিজয়ের দুবছর পর বখতিয়ার খিলজি তিব্বত অভিযানকালে ঘোড়াঘাট থেকে কামরূপ যাওয়ার জন্য যাত্রা করেন। পথে রংপুরের ঘাঘট নদীর পশ্চিম পাড়ে যাত্রা বিরতি দেন। সে ঘটনার সাক্ষী আজও টিকে থাকা ‘বখতিয়ারপুর’ নামের গ্রামটি। সেখানে বখতিয়ারপুর দুর্গ প্রাচীরের চিহ্ন আছে। গ্রামে বখতিয়ারের সেনাবাহিনীতে কর্মরত আফগান বংশোদ্ভুত খাঁ উপাধিধারী ব্যক্তিদের উত্তর পুরুষরা বাস করেন। তারা নিজেদের পরিচয় দেন ‘পাঠান’ বলে। তাদের দৈহিক গঠনও পাঠানদের মতো। ঘাঘট নদীর পাড়ে অবস্থিত বখতিয়ারপুর গ্রাম থেকে মাহিগঞ্জের বখতিয়ারি মসজিদ সামান্য দূরে। তবে মধ্যযুগে মাহিগঞ্জ যে রংপুরের প্রাণকেন্দ্র ছিল, ইতিহাসে তা পাওয়া যায়। ফলে বঙ্গবিজেতা বখতিয়ারের স্মৃতিবিজড়িত মসজিদ এ অঞ্চলে থাকতেই পারে। বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর রাজ্য বাড়ানোর নমুনা হিসেবে নিজে অথবা তার নিযুক্ত শাসকরা সে সময় এই ছোট্ট মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন বলে এলাকাবাসীর ধারণা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম শাহনাওয়াজ বলেন, ‘বখতিয়ারি মসজিদ মোগলপূর্ব যুগের মসজিদ। ড্রামহীন গম্বুজ, গম্বুজের নিচের ত্রিকোণাকৃতির পেন্ডেন্টিভ নকশা, ছাদের সমতল বুরুজ ও ছোট আকার মসজিদের প্রাচীনতত্ত্ব জানান দেয়। পার্শ্ববর্তী শাহজালাল বোখারির মাজারের অস্তিত্ব এটিকে সুলতানি আমলের মসজিদ হিসেবে বিবেচনায় সহায়তা করে। তবে এটি প্রথম বঙ্গবিজেতা বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক নির্মিত কিনা তা জানার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন। আর তা যদি হয়ে থাকে, তবে সময়ের হিসেবে এটি ৮০০ বছরের প্রাচীন মসজিদ।’
লেখক : আলেম ও মাদরাসা শিক্ষক