ঢাকা ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৮ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্মরণ

মওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
মওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

মুক্তিযোদ্ধা আলেম হিসেবে খ্যাত মওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী আল আজহারী দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন গত বছর ১৯ জানুয়ারি। তিনি ছিলেন এ কালের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি একাধারে লেখক, গবেষক ও ইসলামি চিন্তাবিদ ছিলেন। মাদ্রাসা জীবনে তুখোড় ছাত্রনেতা মওলানা জালালাবাদী দেশ স্বাধীনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তবে কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে তিনি জড়িত হননি।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনে লেখক, সম্পাদক ও গবেষকদের বিভিন্ন ফোরামে তার সরব উপস্থিতির সময়ে তার সাথে আমার পরিচয় ও সখ্যতা। তার ঈমানি চেতনা, আধ্যাত্মিক গভীরতা, লেখা ও বলার ওজস্বিতা আমাকে মুগ্ধ করত। আমি মওলানা রুমির মসনবি নিয়ে কাজ করছি জেনে তিনি আমার প্রতি বিশেষ অনুরাগ দেখাতেন। বলতেন, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশে আপনার লেখা মসনবির গল্পগুলো নিয়মিত পড়ি। আমি গল্পগুলো বই আকারে ছাপানোর উদ্যোগের কথা জানালে, তিনি বললেন, মসনবির গল্প বললে মানুষ সাধারণ গল্পকাহিনী মনে করবে। আপনি বরং মসনবি শরিফের গল্প বলেন, শরিফ শব্দ সংযোজন করলে মওলানা রুমি ও তার অবিস্মরণীয় কীর্তির প্রতি সম্মান দেখানো হবে। তার পরামর্শেই মসনবির গল্পগুলো ৬ খণ্ডে বই আকারে ছাপাতে গিয়ে নামকরণ করি মসনবি শরিফের গল্প। বলতে গেলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়িয়ে ছিল অগ্রজ ও অনুজের পর্যায়ে। ইন্তিকালের আগে তার ছেলের মাধ্যমে তার লেখা দুটি বই আমার বাসায় পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ পাক ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই আলেমকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন।

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীর জন্ম শুক্রবার ২৯ মে ১৯৪২ সালে সিলেটের টুকেরগাঁও-এর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তিনি সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। পরে ঢাকায় এসে ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। এর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ডিপ্লোমা ইন উর্দু কোর্স সম্পন্ন করেন। সিলেট ও ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রনেতা হিসেবে তার প্রচুর খ্যাতি ছিল। ইসলামি-আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে ১৯৬২-৬৩ সালে ঢাকায় লক্ষাধিক মাদ্রাসা ছাত্রের সভা-শোভাযাত্রা দু-দুবার করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। তখন তিনি মাদ্রাসা ছাত্র সংগঠন ‘জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া’র কেন্দ্রিয় নেতা ছিলেন। তিনি ‘ইসলাম প্রচার দপ্তর’ নামে একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং ওই প্রতিষ্ঠানের অধীনে বেশ কিছু ইসলামি পুস্তক প্রচার করার প্রয়াস পান। তিনি ১৯৭৩ সালে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে মহানবী (সা.) এর জন্ম ও ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে সর্বপ্রথম নবীদিবসের মাহফিলের আয়োজন করেন, যাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। স্বাধীনতা-উত্তর দেশের সংকটাপন্ন মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার এবং এর উন্নয়নে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে কোরআন তিলাওয়াত ও আজান সম্প্রচার পুনরায় শুরু করতে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তারই পরামর্শে সৌদি আরব স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি না দেয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার সর্বপ্রথম হজের ফ্লাইট সৌদি আরবের উদ্দেশে প্রেরণ করেন। ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত হজ যাত্রীদের ‘হজ্ব ওমরাহ ও জিয়ারত’ নামক যে পুস্তক সরকারিভাবে বিতরণ করা হয় তা তিনি রচনা করেছেন বলে জানা যায়।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৬ সালে উচ্চতর ইমাম ট্রেনিংয়ের জন্য সর্বপ্রথম যে দলটি মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিল, তিনি ছিলেন ওই দলের অন্যতম সদস্য। কেবল একজন বিদগ্ধ লেখক, অনুবাদক, সম্পাদকই নন, একজন কর্মবীর ও সচেতন আলেম হিসেবে তিনি সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে তার লিখিত, অনূদিত ও সম্পাদিত অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। সব মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। এছাড়াও তিনি ১৯৭৮ সাল থেকে তার জীবদ্দশায় দীর্ঘদিন মহানবী (সা.)-এর জীবনীর ওপর প্রতি বছর ধারাবাহিক ভাবে ‘মহানবী (স) স্মরণিকা’ শীর্ষক স্মরণিকা প্রকাশ করেছেন, যা প্রিয়নবী (সা) এর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ এবং তা সুধী মহলে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।

তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এর লেখক-গবেষক, সম্পাদক ও বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জুমার খুতবাপূর্ব আলোচক ছিলেন। এছাড়াও দীর্ঘদিন গণভবন ও বাংলাদেশ সচিবালয় মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পূবালী ব্যাংকের সরিয়া কাউন্সিলের পরপর দুই মেয়াদের সদস্য ছিলেন।

তার লিখিত ও অনূদিত গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে- রসূলুল্লাহর (স.) পত্রাবলী, সন্ধি ষ চুক্তি ও ফরমানসমূহ, Holy Prophet's Mission to Contemporary Rulers, ইসলাম ও রাজনীতি, আমি মুক্তিযোদ্ধা আমি রাজাকার, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শাহবাগ বনাম শাপলা, ইসলামের ডাক, ভারত যখন স্বাধীন হচ্ছিল, আল আদাবুল মুফরাদ, জীবন সন্ধ্যায় মানবতা, নবী চিরন্তন (‘নবী পরশমনি’ নামে বাজারে প্রচলিত) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তিনি মওলানা আকরম খাঁ এর বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন বলে জানা যায়।

দৈনিক আজাদে তিনি নিয়মিত লিখতেন। এছাড়াও দৈনিক ইত্তেফাক, নয়া দিগন্ত, দিনকাল প্রভৃতি পত্রিকায় এবং সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ও বার্ষিক ম্যাগাজিনসমূহে তার অসংখ্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ বেতারে ধর্মীয় কথিকা এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। জাতীয় লেখক পরিষদ কর্তৃক তিনি গুণীজন সম্মাননায় ভূষিত হন। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ হতে মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা লাভ করেন।

গেল ২০২৪ সালের ১৯শে জানুয়ারি শুক্রবার মুক্তিযোদ্ধা আলেমখ্যাত লেখক, গবেষক ও ইসলামি চিন্তাবিদ মওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী আল-আজহারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তাকে মিরপুর-১১ এ ‘জান্নাতুল মাওয়া’ কবরস্থানে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন পুত্র ও দুই কন্যা সন্তান রেখে যান।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত