ঢাকা শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইতিহাস

যেভাবে কোরআন সংকলিত হলো

মুফতি শাহেদ রহমানি
যেভাবে কোরআন সংকলিত হলো

আল কোরআন সর্বশেষ আসমানি কিতাব। এ কিতাব আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। পবিত্র কোরআন মুসলমানের জীবনবিধান। কেয়ামত পর্যন্ত আগত মানুষের পথনির্দেশক। সঠিক পথের দিশারী। বিশ্বজনীন এ গ্রন্থের আবেদন ও উপযোগিতা সব যুগে এবং সবখানেই কার্যকর। এটা কোরআনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ কোরআনের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, এ গ্রন্থট দুইবার নাজিল হয়েছে। প্রথমে পুরো কোরআনের আয়াত প্রথম আসমানে ‘বাইতুল ইজ্জতে’ নাজিল হয়েছে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৩ বছর ধরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন ঘটনা উপলক্ষে, যুগ-জিজ্ঞাসার জবাবে নাজিল হয়েছে। কুদরতি নিয়মে হাজারো বছর ধরে অত্যন্ত বিস্ময়কর প্রক্রিয়ায় এ গ্রন্থকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লিখে রাখার পাশাপাশি হাজারো বছর ধরে হৃদয় থেকে হৃদয়ে একে ধারণ করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোরআনের লাখো হাফেজ রয়েছেন। মানব ইতিহাসে আর কোনো গ্রন্থের এত হাফেজ নেই।

নবীজির যুগে কোরআন সংরক্ষণ : পূর্ণ কোরআন একসঙ্গে নাজিল হয়নি; বরং বিশেষ প্রয়োজনীয়তা ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটু একটু করে অবতীর্ণ হয়েছে। তাই নবী (সা.)-এর যুগে শুরু থেকেই বই আকারে একে সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। আসমানি গ্রন্থগুলোর মধ্যে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনকে এ বিশেষত্ব দান করেছেন যে কলমণ্ডকাগজের চেয়েও একে অগণিতসংখ্যক হাফেজের স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করেছেন। মুসলিম শরিফের হাদিসে আছে, আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় হাবিব (সা.)-কে বলেছেন, ‘আমি আপনার ওপর এমন কিতাব অবতীর্ণ করব, যাকে পানি ধুয়ে নিতে পারবে না।’ অর্থাৎ দুনিয়ার সাধারণ গ্রন্থগুলোর অবস্থা এই যে পার্থিব বিপর্যয়ের কারণে সেগুলো ধ্বংস হয়ে যায়; কিন্তু কোরআনকে মানুষের অন্তরে অন্তরে এমনভাবে সংরক্ষণ করা হবে যে তা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোনো শঙ্কাই থাকবে না। তাই প্রথম দিকে লেখার চেয়েও কোরআন মুখস্থ করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে নবী (সা.)-এর জীবদ্দশায়ই সাহাবায়ে কেরামের একটি বড় অংশ হাফেজে কোরআন হয়েছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন- হজরত আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী, তালহা, সাআদ, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হুজায়ফা বিন ইয়ামান, হজরত সালেম, আবু হুরায়রা, ইবনে ওমর, ইবনে আব্বাস, আমর ইবনুল আস, আবদুল্লাহ বিন আমর, মুয়াবিয়া, ইবনে জুবাইর, আবদুল্লাহ বিন আস্ সায়েব, আয়েশা, হাফসা, উম্মে সালমা, উম্মে ওয়ারাকা, উবাই ইবনে কাআব, মাআজ ইবনে জাবাল, আবু হুলাইমা মাআজ, জায়েদ ইবনে সাবেত, আবুদ্ দারদা, মুজাম্মা বিন জারিয়া, মাসলামা বিন মুখাল্লিদ, আনাস ইবনে মালেক, উকবা বিন আমের, তামিম দারেমি, আবু মুসা আশআরি এবং হজরত আবু জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ অন্যতম হাফেজ সাহাবি ছিলেন। (আল-ইতকান : ১/৭৩-৭৪)। মূলত উল্লিখিত নামগুলো সেসব সাহাবির, যাদের নাম ইতিহাসে হাফেজে কোরআন হিসেবে সংরক্ষিত। অন্যথায় আরো অনেক সাহাবির কোরআন মুখস্থ ছিল।

নবীজির যুগে কোরআন সংকলন : আরবদের প্রখর স্মৃতিশক্তির বিষয়ে বিশ্বজুড়ে সুনাম রয়েছে। আরবদের এ প্রখর স্মৃতিশক্তির ওপর ভর করে কোরআন সংরক্ষণের পাশাপাশি নবী (সা.) লিখিতভাবে কোরআন সংকলন, সংরক্ষণ ও একত্রীকরণের ব্যবস্থা করে গেছেন। অহির ইলম লিপিবদ্ধ করার জন্য তিনি ৪০ জন ‘কাতেবে অহি’ (অহি লেখক) নিযুক্ত করেছেন। রাসুল (সা.)-এর যুগে কাগজ ছাড়াও পাথর, চামড়া, খেজুরের ডাল, বাঁশের টুকরা, গাছের পাতা এবং চতুষ্পদ জন্তুর হাড্ডির ওপর কোরআন লিখে রাখা হতো। এভাবেই রাসুল (সা.)-এর তত্ত্বাবধানে কোরআনের একটি কপি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল, যদিও তা পুস্তিকারূপে ও গ্রন্থিত আকারে ছিল না। এ ছাড়া সাহাবায়ে কেরামের কারো কারো কাছে ব্যক্তিগতভাবে কোরআনের সম্পূর্ণ অথবা অসম্পূর্ণ কপি বিদ্যমান ছিল। যেমনটা বোখারি শরিফের এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) কোরআন নিয়ে (অর্থাৎ কোরআনের কপি নিয়ে) শত্রুদের ভূখণ্ডে সফর করতে নিষেধ করেছেন।’ (বোখারি : ১/ ৪১৯)।

প্রথম খলিফার যুগে কোরআন সংকলন : রাসুল (সা.)-এর যুগে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন বস্তুর ওপর কোরআন সংরক্ষিত ছিল, তাই ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নিজ খেলাফতের সময় বিক্ষিপ্ত অংশগুলো একত্র করে সংরক্ষণের প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে সহিহ বোখারি শরিফে। হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা) বলেন, ‘ইমামার যুদ্ধের পরপরই হজরত আবু বকর (রা.) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি সেখানে গিয়ে দেখি ওমর (রা.)ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আবু বকর (রা.) আমাকে বললেন-ওমর (রা.) এসে আমাকে বলেছেন, ‘ইমামার যুদ্ধে কোরআনে হাফেজদের একটি বড় অংশ শহিদ হয়ে গেছে। আর এভাবেই যদি বিভিন্ন স্থানে কোরআনের হাফেজরা শহিদ হতে থাকেন, তাহলে আমার আশঙ্কা হয়, কোরআনের একটি বড় অংশ হারিয়ে যাবে। তাই আমার অভিমত হলো, আপনি চাইলে কোরআন সংকলনের নির্দেশ দিতে পারেন।’ আমি তাকে বললাম, ‘যে কাজ রাসুল (সা.) করেননি, সেই কাজ আমি কীভাবে করব?’ জবাবে ওমর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর কসম, এ কাজ উত্তমই উত্তম। এরপর ওমর (রা.) বারবার আমাকে একই কথা বলতে লাগলেন। একপর্যায়ে এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা আমার অন্তর খুলে দিলেন। এখন ওমরের অভিমত যা, আমার অভিমতও তা-ই।’ এরপর আবু বকর (রা.) আমাকে বললেন, ‘তুমি বিচক্ষণ যুবক, তোমার ব্যাপারে আমাদের কোনো খারাপ ধারণা নেই। রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় তুমি অহি লেখার কাজ করতে। তাই তুমিই কোরআনের আয়াতগুলো অনুসন্ধান করে সেগুলো একত্র করো।’

জায়েদ (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম, তারা যদি আমাকে সস্থান থেকে কোনো পাহাড় সরানোর আদেশ দিতেন, তাহলে তা আমার কাছে এত কঠিন মনে হতো না, যতটা কঠিন মনে হয়েছে কোরআন সংকলনের দায়িত্ব পালনের নির্দেশটি।’ আমি বললাম, ‘আপনারা এমন কাজ কীভাবে করবেন, যা রাসুল (সা.) করেননি?’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর কসম, এ কাজে কল্যাণই কল্যাণ রয়েছে। এরপর তিনি আমাকে বারবার তা বলতে লাগলেন। একপর্যায়ে এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা আমার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিলেন, যে বিষয়ে বক্ষ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন হজরত আবু বকর ও ওমর (রা.)-কে। অতঃপর আমি কোরআনের আয়াত অনুসন্ধান করতে লাগলাম।

সুতরাং কোরআনের আয়াতগুলো খেজুরের ডাল, পাথরের তখতি এবং মানুষের হৃদয় থেকে খুঁজে খুঁজে আমি তা একত্র করলাম। সুরা তওবার শেষ আয়াত আবু খুজাইমা আনসারি (রা.)-এর কাছে পেলাম, অন্যদের কাছে (লিখিতভাবে) তা আমি পাইনি’। বোখারি : ৪৯৮৬)। তবে নিঃসন্দেহে সে আয়াতটি হাফেজ সাহাবিদের মুখস্থ ছিল এবং সেটি ‘মুতাওয়াতির’ বর্ণনা দ্বারাও কোরআনের আয়াত হওয়া প্রমাণিত। (উলুমুল কোরআন, তকি উসমানি : ১৮৫)।

চার পদ্ধতিতে কোরআন গবেষণা : হজরত জায়েদ (রা.) নিজে কোরআনে হাফেজ ছিলেন, তা সত্ত্বেও এককভাবে কোরআন সংকলনের গুরুদায়িত্বটি পালন করেননি, বরং তিনি চারটি পদ্ধতিতে কোরআন সংকলন করতেন। এক. কোনো আয়াত পাওয়া গেলে সর্বপ্রথম তা নিজের হিফজ ও মুখস্থের সঙ্গে মিলিয়ে নিতেন। দুই. হজরত উমর (রা.)ও হাফেজ ছিলেন।

বর্ণিত আছে যে তিনিও আবু বকর (রা.)-এর নির্দেশে জায়েদ (রা.)-কে সহযোগিতা করতেন। তিন. কোনো আয়াত ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করা হতো না যতক্ষণ না দুজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি এ কথার সাক্ষ্য দিতেন যে এ আয়াত রাসুল (সা.)-এর সামনে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে অথবা সেগুলো রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর আগে তার কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। সুরা তাওবার শেষ আয়াতটি যখন কেবল হজরত আবু খুজাইমা (রা)-এর কাছে পাওয়া গেছে তখন এ সূত্রে সেটিকে গ্রহণ করা হয়েছে যে জীবদ্দশায় রাসুল (সা.) সে সাহাবির একজনের সাক্ষ্যকে দুজনের সাক্ষ্যের সমতুল্য ঘোষণা করে গেছেন। চার. অবশেষে চূড়ান্ত পর্যায়ে সে আয়াতগুলোর সমষ্টিকে বিভিন্ন সাহাবির ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগৃহীত কোরআনের পাণ্ডুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হতো।

প্রথম সংকলিত কোরআন : আবু বকর (রা.) প্রথম পবিত্র কোরআনকে সংকলিত করেছেন। তার সংকলিত কোরআনকে পরিভাষায় ‘উম্ম’ বা আদি কোরআন বলা হয়। কেননা এটিই প্রথম লিখিত সুবিন্যস্ত কোরআন। এর বৈশিষ্ট্য হলো- এটি নবী (সা.) বর্ণিত ধারাক্রম অনুসারে প্রস্তুত করা হয়েছে। সুরাগুলো আলাদা রেখে দেয়া হয়েছে; সুরার ক্রমধারা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। এটি সাত হরফ বা সাত কেরাতে লেখা হয়েছে। এ কপিটি হীরার হস্তাক্ষরে লেখা হয়েছে। এখানে কেবল সেসব আয়াত লেখা হয়েছে, যেগুলোর তেলাওয়াত রহিত হয়নি। এই সংকলনের উদ্দেশ্য ছিল একটি সুবিন্যস্ত, গ্রন্থিত কোরআনের কপি সংগ্রহ করা, যাতে প্রয়োজনের সময় এর দ্বারস্থ হওয়া যায়। এটি ১৩ হিজরিতে শুরু হয়ে পূর্ণ এক বছর মতান্তরে প্রায় দুই বছরে সমাপ্ত হয়। (তারিখুল কোরআনিল কারিম, তাহের আল কুরদি : ১/২৮)।

হজরত আবু বকর (রা.) সংকলিত কোরআনটি মৃত্যু পর্যন্ত তার কাছেই ছিল। এরপর উমর (রা.)-এর কাছে। তার শাহাদাতের পর নিজ অসিয়ত মোতাবেক নবী (সা.)-এর স্ত্রী, নিজ কন্যা হাফসা (রা.)-এর কাছে ছিল। অতঃপর মারওয়ান বিন হাকাম তার রাজত্বকালে এ কপিটি চাইলে তিনি তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। হাফসা (রা.)-এর ইন্তেকালের পর মারওয়ান এ কপি হজরত ইবনে উমর (রা.)-এর কাছ থেকে নিয়ে যান। অতঃপর তিনি এ চিন্তা করে সেটি জ্বালিয়ে দিয়েছেন যে উসমান (রা.)-এর খেলাফত আমলে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তুতকৃত কপির সঙ্গে এর কেরাতের পার্থক্যের কারণে অদূর ভবিষ্যতে ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কেননা, উসমান (রা.) সাত কেরাতের পরিবর্তে এক কেরাত, আঞ্চলিক একাধিক ভাষার পরিবর্তে প্রমিত এক ভাষায় সে কোরআনটি সংকলন করেছেন। (উলুমুল কোরআন, তকি উসমানি : ১৮৬-১৮৭) ।

কোরআনের পাঁচ নাম : ভাষা ও পরিভাষার স্বীকৃত নিয়মণ্ডকানুন অনুসারে পবিত্র কোরআনের পাঁচটি নাম আছে- ‘আলকুরআন’, ‘আলফুরকান’, ‘আলকিতাব’, ‘আযযিকর’ ও ‘আততানযীল’। এই পাঁচটি শব্দ পবিত্র কোরআনের মূল নাম। এছাড়া অন্য আরো নাম আছে। সেগুলো কোরআনের বিশেষণ। পবিত্র কোরআন কেয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। কেননা, আল্লাহ নিজে কোরআন সংরক্ষণ করবেন মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত