সংশয়হীন সিদ্ধান্তের পর ইবরাহিম (আ.) ইসমাইলকে নিয়ে মক্কার হেরেম এলাকা থেকে মিনা প্রান্তরে রওনা হলেন। তাসিরে খাজেনে কাবুল আহবার ও ইবনে ইসহাক সূত্রে বর্ণিত, ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়ে ছেলে কোরবানির সিদ্ধান্ত নিলে ইবলিস বলল, এ ব্যাপারে ইবরাহিমের বংশধরকে পথভ্রষ্ট না করতে পারলে জীবনে তাদের কাউকে আমার দ্বারা বিভ্রান্ত করা সম্ভব হবে না। এ কথা বলেই সে মানুষের বেশে প্রথমে ইসমাঈলের মায়ের কাছে গেল। বলল, মা তুমি কি জান তোমার ছেলেকে নিয়ে ইবরাহিম কোথায় গেছে। বললেন, পাহাড়ের কাছে লাকড়ি আনতে গেছেন। বলল, না; বরং তোমার ছেলেকে জবাই করতে নিয়ে গেছে। মা বলল, তা হতে পারে না। আমার ছেলের প্রতি তার বাবার অনেক দরদ ও ভালোবাসা। ইবলিস বলল, ইবরাহিম মনে করছে আল্লাহ তাকে আদেশ করেছেন। মা বললেন, আল্লাহ আদেশ দিলে তিনি তা পালন করবেন, তাতে তোমার কী; বরং আল্লাহর আদেশ পালন করা উত্তম। ইবলিস নিরাশ হয়ে চলে গেল।
এবার ইসমাইলের কাছে গেল। ইসমাইল তার বাবাকে অনুসরণ করে হাঁটছিল। মানুষরূপী ইবলিস বলল, হে বালক, তুমি কি জান তোমার বাবা তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ইসমাইল বললেন, উপত্যকার কাছে লাকড়ি জোগাড় করতে। ইবলিস বলল, তোমাকে জবাই করতে যাচ্ছেন। বললেন, কেন এমন করবেন? বলল, তোমার বাবাকে নাকি আল্লাহ এই নির্দেশ দিয়েছেন? বললেন, আল্লাহর আদেশ তো আমি মাথা পেতে মেনে নেব। ইবলিস নিরাশ হয়ে ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে গেল। বলল, শায়খ, শয়তান আপনাকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য আদরের ছেলেকে কোরবানি দিতে যাচ্ছেন? ইবরাহিম (আ.) বললেন, এখান থেকে দূর হও হে আল্লাহর দুশমন। আমি অবশ্যই আমার আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন করব। ইবরাহিম (আ.) ও তার পরিবারকে ধোঁকা দিতে না পারার মনস্তাপ নিয়ে শয়তান অপমানিত হয়ে ফিরে গেল। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ইবরাহিম (আ.) তার ছেলে কোরবানি দিতে আদিষ্ট হলে শয়তান জামারাতুল উকবায় তার সামনে আসে। ইবরাহিম তখন তাকে সাতটি কঙ্কর মারেন। শয়তান দূরে সরে যায়। জামারাতুল উস্তায় শয়তান আবারও তার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালে সেখানেও তিনি শয়তানের দিকে সাতটি কঙ্কর মারেন। শয়তান জামারাতুল উখরায় তার সামনে আসলে তখনও ইবরাহিম (আ.) সাতটি পাথর মারেন। তাতে শয়তান দূর হয়ে যায়। অতঃপর ইবরাহিম (আ.) আল্লাহতায়ালার আদেশ পালনে অগ্রসর হন।
প্রতিবছর হাজিরা আরাফাতের ময়দানে হাজেরি এবং মুযাদালিফা উপত্যকায় রাত যাপনের পর ১০ জিলহজ মিনা প্রান্তরে পৌঁছে প্রথমে জামারাতুল উকবায় সাতটি পাথর নিক্ষেপ করেন। এরপরই তারা কোরবানির পশু জবাই করেন। পরের দুই দিনও মিনায় রাত যাপন করে শয়তানকে পাথর মারতে হয়। মিনায় কোরবানি দেওয়ার পর মোট তিনদিন অবস্থানকালে শয়তানের প্রতীক জামারায় পাথর মারা ছাড়া অন্য কোনো দৃশ্যমান আমল নেই। তাতে বুঝা যায় শয়তানকে পাথর মারার অনুশীলন কত গুরুত্বপূর্ণ। শয়তানকে চেনা, শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার বিশ্বজনীন প্রশিক্ষণের জন্যই হজের সময়ের এই আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু আমরা কী এর থেকে কোনোরূপ শিক্ষা গ্রহণ করি? আমাদের দৈনন্দিন জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবনের জন্য এই পাথর মারার অনুশীলনের বাস্তব অনুসরণের প্রয়োজন কি আমরা অনুভব করি। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর এত বড় নবী হওয়া সত্ত্বেও তাকে শয়তানের প্রতারণার মোকাবিলা কীভাবে করতে হলো, আমাদের ভেবে দেখা উচিত। কোরআনে আছে, ‘দুজনেই যখন আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিল। আর ইবরাহিম তাকে উপুড় করে শুইয়ে দিল।’ (সুরা সাফফাত : ১০৩)। ইবরাহিম (আ.) ছেলেকে মাটির ওপর শোয়ালেন। ইবনে আব্বাস (রা.)-এর ভাষ্য মতে, কাত করে কপালের পার্শ্বদেশের ওপর শোয়ালেন। প্রস্তুতির এ পর্যায়ে পিতা ও পুত্রের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হয়, তাফসির ও ইতিহাসগ্রন্থসমূহে এর বর্ণনা এভাবে এসেছে-
‘ইসমাইল পিতাকে বললেন, পিতা, আমাকে খুব শক্ত করে বেঁধে নিন, যাতে আমি বেশি ছটফট করতে না পারি। আপনার পরিধেয় বস্ত্রও সামলে নিন, যাতে আমার রক্তের ছিঁটা তাতে না পড়ে। এতে আমার সওয়াব হ্রাস পেতে পারে। এছাড়া রক্ত দেখলে আমার মা অধিক ব্যাকুল হবেন। আপনার ছুরিটিও ধার দিয়ে নিন এবং তা আমার গলায় দ্রুত চালাবেন, যাতে আমার প্রাণ সহজে বের হয়ে যায়। কারণ, মৃত্যু বড় কঠিন ব্যাপার। আপনি আমার মায়ের কাছে পৌঁছে আমার সালাম বলবেন। যদি আমার জামা তার কাছে নিয়ে যেতে চান, তবে নিয়ে যাবেন। হয়তো তিনি এতে কিছুটা সান্ত¡না পাবেন।’
ছেলের মুখে এসব কথা শুনে পিতার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু ইবরাহিম (আ.) দৃঢ়তার পাহাড় ছিলেন, ‘ইবরাহিম (আ.) বললেন, ছেলে, আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য তুমি আমার চমৎকার সহায়ক।’ ছেলে যেভাবে বললেন, ইবরাহিম সেভাবে করলেন। তিনি এগিয়ে এসে ছেলেকে চুমো দিলেন এবং ভেজা চোখে বেঁধে নিলেন। তখন ছেলে কাঁদছিলেন। এরপর ছেলের গলায় ছুরি চালালেন; কিন্তু কিছুই কাটছিল না। তিনি কয়েকবার চেষ্টা করলেন, কাজ হলো না। আল্লাহর আদেশে ছুরি কিছুই কাটছিল না। সুদ্দির মতে, আল্লাহতায়ালা আপন কুদরতে পিতলের একটি পাত মাঝখানে অন্তরায় করে দিয়েছিলেন।
তখন ছেলে নিজেই আবদার করে বললেন, হে পিতা, আপনি আমাকে উপুড় করে শুয়ে দিন। কেননা, আপনি যখন আমার চেহরার দিকে তাকাবেন, তখন আপনার মধ্যে পৈতৃক স্নেহ উথলে উঠবে এবং আপনার মধ্যে এমন হৃদকম্পন হবে, যা আপনার ও আল্লাহর আদেশ পালনে অন্তরায় হয়ে যাবে। আর আমিও ছুরির দিকে তাকালে ঘাবড়ে যাব। ইবরাহিম (আ.) তাই করলেন। গর্দানে ছুরি চালালেন, কিছুই হলো না। (তাফসিরে খাজেন)। এ সময়েই আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, হে ইবরাহিম, তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে। এভাবেই আমি সৎকর্র্মপরায়ণদের পুরষ্কৃত করে থাকি।’ (সুরা সাফফাত : ১০৪, ১০৫)। আল্লাহর প্রতি ঈমান ও ভালোবাসার এত বড় এবং এত প্রকাশ্য পরীক্ষা, যেখানে পিতা আল্লাহর হুকুম পালনার্থে একমাত্র ছেলেকে নিজ হাতে জবাই করার চেষ্টা করছেন, আর ছেলে সানন্দচিত্তে জবাই হতে নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন। আল্লাহ খুশি হয়ে সেখানে পশু পাঠিয়ে দিলেন। পবিত্র কেবারআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি জবাই করার জন্য একটি বিরাট কোরবানির পশু তার বদলায় দিলাম।’ (সুরা সাফফাত : ১০৭)।
তকবিরে তাশরিকের হাকিকত
ইবরাহিম (আ.) ইসমাইলের পরিবর্তে যে ভেড়া জবাই করলেন, কোরআন মাজিদে একে বিরাট কোরবানির পশু হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। মুফাসসিররা বলেছেন, যে ভেড়া আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে, ফেরেশতা জিবরাইল নিয়ে এসেছেন, ছেলে কোরবানির বিরাট পরীক্ষার বিনিময়ে প্রাপ্ত হয়েছে তা তো মর্যাদার দিক দিয়ে বিরাট হবেই। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী, এই পশু আদম (আ.)-এর ছেলে হাবিলের কেবারবানির ভেড়া, যা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছিল। দীর্ঘ ৪০টি বসন্তু বেহেশতের বাগানে প্রতিপালিত হয়েছে আর ইসমাইল (আ.)-এর বেলায় দ্বিতীয়বার কবুল হয়েছে তা তো বিরাট নামে আখ্যায়িত হবেই।
‘হে ইবরাহিম’, নামে গায়েবি আওয়াজ শুনে ইবরাহিম (আ.) যখন উপরের দিকে তাকান, তখন দেখেন ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) দণ্ডায়মান। তার সঙ্গে সফেদ রঙের শিঙযুক্ত মোটাসোটা একটি ভেড়া। জিবরাইল বললেন, এই পশু আপনার ছেলের বিনিময়ে আপনার জন্য উৎসর্গিত। আপনি ইসমাইলের পরিবর্তে এটি জবাই করুন। তখনই জিবরাইল বলছিলেন, ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর।’
ইবরাহিম এর সঙ্গে বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর।’ আর ইসমাইল বললেন, ‘আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ এই তাকবির ঈদের দিনগুলোতে ও হজের মানাসিক চলাকালে পাঠ করার রেওয়াজ শুরু হয় তখন থেকে। (তাফসিরে কাশফুল আসরার, খাজা আব্দুল্লাহ আনসারি ও রশিদ উদ্দিন মাইবেদি)।
এই সেই তাকবিরে তাশরিক- যা আমরা আইয়ামে তাশরিকের দিনগুলোতে পাঠ করি। ৯ জিলহজ ফজরের পর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর কমপক্ষে একবার পাঠ করা ওয়াজিব। এই তাকবির পাঠ করার বিধান এ জন্যে দেওয়া হয়েছে, যাতে আমরা আমাদের চেতনার আকাশে ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)-এর সেই কোরবানির চেতনাকে জাগ্রত করি। কোরআনে আছে, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না এগুলোর গোশত এবং রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ : ৩৭)