ঢাকা মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মালদ্বীপে যেভাবে ইসলাম পৌঁছেছে

মুহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন
মালদ্বীপে যেভাবে ইসলাম পৌঁছেছে

প্রাকৃতিক দ্বীপপুঞ্জ ও নান্দনিক মনোভিরাম সৌন্দর্যভূমি- মালদ্বীপের অবস্থান ভারত মহাসাগরে। শ্রীলঙ্কা থেকে আনুমানিক ৪০০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। আয়তন মাত্র ২৯৮ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই বিশ্বের সবচেয়ে নিচু দেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ উচ্চতা মাত্র দুই দশমিক তিন মিটার। আর গড় উচ্চতা মাত্র এক দশমিক পাঁচ মিটার।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ১ হাজার ১৯০টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশটির ২০০টি দ্বীপ বাসযোগ্য। ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি খুবই প্রাচীন। বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে, সংস্কৃত শব্দ দ্বীপমালা থেকেই মালদ্বীপ এসেছে। কারও মতে মালদ্বীপ হচ্ছে দ্বীপরাজ্য। আবার কারও কারও ভাষায় এটি মহল দ্বীপ; যার অর্থ প্রাসাদ।

মুসলিমরাই শুধু নাগরিক : মালদ্বীপের সংবিধান মোতাবেক দেশটির নাগরিক হতে হলে মুসলিম হওয়া আবশ্যক। ফলে অমুসলিম কোনো নাগরিক সেখানে পাওয়া যায় না। ইতিহাসের তথ্য মতে, আরব নাবিক-বণিকদের হাত ধরেই মালদ্বীপে সর্বপ্রথম ইসলামের আগমন। (মান আদখালাল ইসলাম লিল মালদ্বীপ, আল-জাজিরাডটনেট : ২৩/০৫/২০১৯)।

মিশরের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ মাহমুদ শাকির তার কিতাব ‘আত-তারিখুল ইসলামি’তে উল্লেখ করেন, হিজরি ৮৫ সন থেকে মালদ্বীপে ইসলাম আগমন করতে শুরু করে। মানে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে তৎকালীন উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের আমলে মুসলিম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইসলাম সেই অঞ্চলে আলো ছড়াতে শুরু করে। (কিসসাতু দুখুলিল ইসলাম জাজরাল মালদ্বীপ, অ্যারাবিকপোস্টডটনেট; ১৮/১১/২০২০)

ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ অনুযায়ী, মালদ্বীপে ইসলাম ভিন্নভাবে পৌঁছায়। মরোক্কোর এক পরিব্রাজক ও সোমালিয়ান এক নাবিকের কথা রয়েছে ইতিহাসে। সেটি বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম পরিব্রাজক ইবনে বতুতার দেওয়া তথ্য-উপাত্তে জানা যায়।

মুসলিম ইতিহাসবেত্তা ও পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ১১৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মালদ্বীপ ভ্রমণ করেছিলেন। তার আগমনের আগে দ্বাদশ শতক থেকেই মালদ্বীপে মুসলিম শাসন চলমান ছিল। জানা গেছে, ১১৫৩-১৯৫৩ অবধি (৮০০ বছর) ৯২ জন সুলতান নিরবচ্ছিন্নভাবে দ্বীপরাষ্ট্রটি শাসন করেন।

শতভাগ মুসলমানের দেশ : মালদ্বীপে এক সময় কোনো মুসলমান ছিল না। কিন্তু বর্তমানে এখন শতভাগ নাগরিক মুসলমান। কীভাবে মালদ্বীপে ইসলামের আলো ছড়ালো? এ নিয়ে এক অলৌকিক কাহিনীর বয়ান রয়েছে। মালদ্বীপের ইতিহাসেও তা লিপিবদ্ধ আছে। (কাইফা দাখালাল ইসলাম ইলাল মালদ্বীপ, অ্যারাবিক বায়্যিনাত : ১৫/০৬/২০১৯)

যেভাবে পৌঁছাল ইসলাম : ইবনে বতুতা মালদ্বীপে নেমে দেখেন সবাই মুসলমান। কিন্তু সেখানে কোনো ইসলাম প্রচারক যাননি। তাহলে তারা সবাই কীভাবে ইসলাম গ্রহণ করলো- তা জানতে তিনি সেখানকার অধিবাসীদের জিজ্ঞেস করলেন। দেশটির বাসিন্দারা তখন অত্যন্ত আশ্চর্যজনক একটি ঘটনা শোনায়। তা হলো- তখন ১১৪০ সাল। মালদ্বীপের রাজা ছিল সনুরাজা। আরবের কোনো এক বাণিজ্য-জাহাজ তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রঝড়ে আক্রান্ত হয়। এতে জাহাজের সব অভিযাত্রী মারা যান। তবে একজন কোনোভাবে ভেঙে যাওয়া জাহাজের কাঠখণ্ড আঁকড়ে ধরে মালদ্বীপে এসে আশ্রয় নেন। ভিনদেশি এই যাত্রী ছিলেন, একজন আরব যুবক ও পবিত্র কোরআনের হাফেজ। তার নাম আবুল বারাকাত ইউসুফ আল-বারবারি আল-মাগরিবি। (কিসসাতুলি ইফরিত আল্লাতি আদখালাতিল ইসলাম ফি জাজারিল মালদ্বীপ, আমল খালেদডটনেট : ১১ জুলাই ২০১৮)।

অচেনা এই দ্বীপে কোথায় যাবেন আবুল বরাকাত? কার কাছে মিলবে তার আশ্রয়? খুঁজে-ফিরে এক বৃদ্ধার ঘরে আশ্রয় পান তিনি। আবুল বারাকাত তখন সবেমাত্র শৈশব পেরিয়ে কৈশোর-যৌবনে পদার্পণ করেছেন। তার চেহারাবয়বে তাই দাড়িগোঁফও গজায়নি।

বন থেকে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন তিনি। এভাবেই চলছিল তার জীবন। একদিন বাড়ি ফেরে দেখেন আশ্রয়দানকারী বৃদ্ধা কাঁদছেন। সঙ্গে বৃদ্ধার মেয়েটিও কাঁদছে। তিনি কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। তখন বৃদ্ধা বললেন, আজ আমার মেয়ে মারা যাবে। আবুল বারাকাত জিজ্ঞেস করলেন, কেন মারা যাবেন? তিনি তো সুস্থ! বৃদ্ধা বললেন, ওই দেখ মৃত্যু আমাদের সামনে। বাড়ির সামনে তাকিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, রাজার সৈন্যরা দাঁড়িয়ে আছে।

জানতে চাইলেন, তারা কি আপনার মেয়েকে হত্যা করবে? বৃদ্ধা বললেন, না। ব্যাপারটি তা নয়। রাজার সৈন্যরা আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছে। কারণ, আমাদের এই দ্বীপে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট তারিখে এক সামুদ্রিক বিপদ ধেয়ে আসে। তবে রক্ষা পাওয়ার উপায় হলো- দ্বীপবাসীদের পক্ষ থেকে একজন তরুণীকে ওইদিন সূর্যাস্তের পর সমুদ্র উপকূলের মন্দিরে রেখে আসতে হয়। পরের দিন সকালে রাজদরবারের লোকজন সমুদ্রের কিনারা থেকে ওই মেয়ের লাশ উদ্ধার করে আনে। কোন্ মেয়েকে পাঠানো হবে- তা প্রতিবারই লটারির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে এবার লটারিতে আমার মেয়ের নাম এসেছে। তাই আজ রাতে তাকে সমুদ্র উপকূলে পাঠাতে হবে। কিন্তু সেখানে পাঠালে তো তার মৃত্যু অনিবার্য। (কনভারসেশন অব দ্য মালদ্বীপস টু ইসলাম, ইসলামসিটি : ২৯/০৩/২০২১)।

বৃদ্ধার এমন বেদনাবিধুর কথা শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন আবুল বারাকাত। পরোপকারী ও কৃতজ্ঞ তরুণ তখন বললেন, আপনার মেয়েকে পাঠানোর দরকার নেই। আমি নিজেই আজ রাতে সেখানে যাব- দেখি কী হয়। প্রয়োজন পড়লে আপনার মেয়ের পরিবর্তে আমি নিজের প্রাণ দেব। রাজার সৈন্যরা না চিনতে পারে মতো করে আপনার মেয়ের পোশাক আমাকে পরিয়ে দিন। ভালোভাবে ওই রকম করে সাজিয়ে দিন। আমিই তাদের সঙ্গে যাব।

আবুল বারাকাত আরব ছিলেন। দেখতে সুন্দর ও সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ। ফলে তার ধরা পড়ার আশঙ্কা তেমন ছিল না। তবে বৃদ্ধা নির্ঘাত মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিতে কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু যুবকটি বললেন, তিনি মুসলমান। মুসলমান এক আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। আর জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। আল্লাহর হুকুম না হলে কেউ কাউকে মারতে পারে না। তা ছাড়া তিনি হাফেজে কুরআন। তাই তাঁর বিশ্বাস কোরআনের বরকতে মহান আল্লাহতায়ালা তাকে রক্ষা করবেন। (মালদ্বীপ্স এম্ব্রেস্ড ইসলাম ডে, ইন্সাইক্লোপিডিয়া২; দ্য ফ্যি ডিকশনারি ডটকম।)

যুবকের পীড়াপীড়িতে বৃদ্ধা রাজি হলেন। রাজার সৈন্যরা এসে তাকে নিয়ে গেল। তরুণীরূপী আবুল বারাকাতকে তারা সৈকতের নির্জন ওই মন্দিরে রেখে চলে এল। যুবক সেখানে এশার নামাজ আদায় করল। এরপর উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে সমুদ্রের ঢেউ দেখতে লাগলেন। একইসঙ্গে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতে শুরু করেন। রাত গভীর হলে চারিদিক নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায়। সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। প্রকৃতি নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে। হাফেজ আবুল বারাকাত রাতের নিথর-নিস্তব্দ পরিবেশে অপেক্ষমাণ। সমুদ্রের কিনারায় সেই ‘ভয়ংকর মন্দিরে’ বসে হৃদয়স্পর্শী সুরে কোরআন তিলাওয়াত করেই যাচ্ছিলেন। কারণ, সব ধরনের অপশক্তির মোকাবিলায় কোরআনই তার দুর্দমনীয় হাতিয়ার। (কাইফা দাখালাল ইসলাম ইলাল মালদ্বীপ, অ্যারাবিক বায়্যিনাত : ১৫/০৬/২০১৯)।

হার মানল সমুদ্রদৈত্য : সময় বয়ে চলে। আর আবুল বারাকাত অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ করে সমুদ্রে-দিগন্তে বিশাল আকৃতির এক ভয়ঙ্কর দৈত্যের উদয় হলো। দৈত্যটি ধীরে ধীরে মন্দিরের অভিমুখে আসতে লাগল। কিন্তু কাছাকাছি এসে দৈত্যটি আচমকা থেমে গেল। আর এই দিকে আবুল বারাকাত কোরআন তিলাওয়াত করেই যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছিল কোরআন তিলাওয়াতের আবেশে কোনো এক অলৌকিক কারণে দৈত্যটি সামনে অগ্রসর হতে পারছিল না। অবশেষে হার মানল ভয়ঙ্কর দানবটি। কিছু সময় অবস্থান করে ভয়াবহ দানবটি যে পথে এসেছিল সে পথে ফিরে গেল। এক-সময় সমুদ্রে মিলিয়ে গেল।

অপরদিকে রাত পেরিয়ে সকাল হলো। সরকারি লোকজন যথারীতি লাশ নেওয়ার জন্য মন্দিরে এলো। কিন্তু তারা হতভম্ব হয়ে গেল। সেখানে কোনো লাশ নেই কোনো মেয়েও নেই। তার পরিবর্তে এক মুসলিম যুবককে দেখতে পেল তারা। সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে এলো রাজার কাছে। আবুল বারাকাত তখন রাজাকে সবকিছু খুলে বললেন। বিস্মিত রাজা তখন বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওই মেয়েটিকে ডেকে আনলেন। মেয়েটি ও তার বৃদ্ধা মা রাজার কাছে ঘটনার সত্যায়ন করেন। (কিসসাতু দুখুলিল ইসলাম জাজরাল মালদ্বীপ, অ্যারাবিকপোস্টডটনেট; ১৮/১১/২০২০)

একসঙ্গে ইসলামে অভিষেক : রাজা এমন ঘটনায় সীমাহীন প্রভাবিত হলেন। তিনি বললেন, হে যুবক, এত বড় বিপদের সামনে তুমি একাকী দাঁড়ালে কীভাবে? যুবক বলল, আমি একা ছিলাম না আমার সঙ্গে আমার আল্লাহ ছিলেন। আর আমার হাতিয়ার ছিল মহান আল্লাহর পবিত্র কোরআন। রাজা ফের জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ভয় পাওনি কেন? যুবক জবাব দিল, মুসলমান আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায় না। জীবন ও মৃত্যুর মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ।

এরপর রাজা বললেন, আগামী বছর এভাবে একা থামাতে পারবে দানবকে? যুবক দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিল, আল্লাহর হুকুমে একাই যেতে পারব। তখন রাজা অতি উৎসাহিত হয়ে বলে উঠলেন, যদি তুমি পার, তাহলে আমরা সবাই ইসলামের সততার সামনে মাথা নত করব। রাজার এ কথাকে সবাই সমর্থন করল। এরপর পরবর্তী বছর নির্ধারিত তারিখের ঘটনা সবাই প্রত্যক্ষ করল, অর্থাৎ ওই যুবকের মোকাবিলায় সাগর দানো এবারও ব্যর্থ হয়ে ফিরল। (কনভারসেশন অব দ্য মালদ্বীপস টু ইসলাম, ইসলামসিটি : ২৯/০৩/২০২১)।

এই ঘটনার পর থেকে সেই মহাবিপদ মালদ্বীপে আর আসেনি। তখন রাজা ও তার দরবারের সবাই ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর পুরো রাজ্যের মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। (মান আদখালাল ইসলাম লিল মালদ্বীপ, আল-জাজিরাডটনেট : ২৩/০৫/২০১৯)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত