ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মানবসভ্যতায় কোরবানির ঐতিহ্য

স্বর্ণের ওজনে বনি ইসরাইলের গাভী

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
স্বর্ণের ওজনে বনি ইসরাইলের গাভী

আবু ইসহাক আস সা’লাবী (র.) সুদ্দী প্রমুখের বরাতে তার তাফসিরে লিখেছেন, বনি ইসরাইল বংশে একলোক ছিল পিতার অতিশয় ভক্ত। পিতৃভক্তিতে তার অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, একবার এক লোক একটি মূল্যবান রত্ন বিক্রি করার জন্য তার কাছে আসল এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা দামে মণিরত্নটি তার কাছে বিক্রি করল। এই লেনদেনে বিরাট লাভ ও মুনাফার ব্যাপার জড়িত ছিল। বিক্রেতা পিতৃভক্ত লোকটিকে বলল, আমাকে রত্নের দামটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দেন। সে বলল, আমার আব্বা ঘুমিয়ে আছেন। সিন্দুকের চাবিটা তার মাথার নিচে রয়েছে। কাজেই তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠা পর্যন্ত আমাকে সময় দিন। উনি জাগ্রত হলে আপনার রত্নের দাম পরিশোধ করব। বিক্রেতা বলল, আপনার বাবাকে ঘুম থেকে জাগান, এখনই আমার মালের দাম দিয়ে দেন। লোকটি বলল, এ কাজ আমি করতে পারব না। এর চেয়ে আপনাকে আমি আরও দশ হাজার টাকা অতিরিক্ত দেব। তবু আমার বাবা ঘুম থেকে জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত আমাকে সময় দিতে হবে।

বিক্রেতা তখন বলল, তার চেয়ে বরং যদি আপনার বাবাকে জাগান আর আমার দামটা এখনই পরিশোধ করেন, আমি অপানকে দশ হাজার টাকা ছাড় দেব। লোকটি জবাবে বলল, না। আমি আপনাকে বিশ হাজার টাকা অতিরিক্ত মূল্য দিতে রাজি আছি, তবুও আমার বাবা নিজ থেকে জাগ্রত হওয়া পর্যন্ত আমাকে সময় দিতে হবে। পরে সেটাই সাব্যস্ত হল এবং তার বাবাকে ঘুম থেকে জাগাল না। বাবা ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর বিষয়টি তাকে অবহিত করা হলো। এতে তিনি এতই খুশি হলেন যে, ছেলের জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করলেন এবং তাকে পুরস্কৃত কর বললেন, তুমি যে মহৎ কাজ করেছ তার বিনিময়ে আমার কাছে যে গাভীটি অবশিষ্ট আছে তা তোমাকে দিলাম। এ হলো বনি ইসরাইলের সেই আলোচিত গাভী। অন্য বর্ণনায় এর বিবরণ ভিন্ন রকম।

ইবনে আব্বাস ও ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বাহ প্রমুখ (র) বলেন, বনি ইসরাইল বংশে একজন নেককার লোক ছিলেন। তার একটি শিশুপুত্র ছিল আর সম্পদ বলতে ছিল একটি গরুর বাছুর। লোকটি একটি জঙ্গলের কাছে গিয়ে বাছুরটি ছেড়ে দিয়ে বলল, প্রভুহে! আমি এই বাছুরটি আমার ছেলে বড় না হওয়া পর্যন্ত তোমার জিম্মায় রাখলাম। এরপরই লোকটি মারা যায়। বাছুরটি জঙ্গলের মধ্যে প্রতিপালিত হতে থাকে এবং এক সময় মাঝারী বয়সের হয়ে যায়। জঙ্গলে কেউ বাছুরটিকে ধরতে চাইলে দৌঁড়ে পালিয়ে যেত।

এই ছেলে বড় হওয়ার পর তার মায়ের ভীষণ ভক্ত হয়। সে রাতকে তিনটি ভাগে ভাগ করত। এক তৃতীয়াংশ সে নামাজ ও ইবাদতে কাটাত। এক তৃতীয়াংশে ঘুমাত আর এক তৃতীয়াংশ মায়ের শিয়রে বসে থাকত। (মায়ের খেদমত করত, তাকে দোয়া কালাম পড়াত, কারণ মা খুব বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।) ভোর হলে সে বনে গিয়ে লাকড়ি জোগাড় করত। লাকড়ির বোঝা মাথায় নিয়ে বাজারে আল্লাহর ভাগ্যে যা রাখেন, সে দামে বিক্রি করত। সেই টাকাও সে তিন ভাগে ভাগ করে খরচ করত। এক ভাগ নিজের জন্য। এক ভাগ গরীরদের মাঝে দান সদকা করত আর বাকি এক ভাগ মায়ের সেবা-যত্নের জন্য খরচ করত।

কাসায়ী ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বাহ থেকে বর্ণনা করেন, বনি ইসরাঈল বংশে একজন নেককার লোক ছিলেন। স্ত্রী গর্ভাবস্থায় তার স্বামী মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর তার একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার নাম রাখে মীশাই। মীশাই বড় হওয়ার পর বন-বাদাড় ও সর্বসাধারণের মালিকানাধীন বৈধ জায়গা থেকে লাকড়ি জোগাড় করে বিক্রি করত এবং নিজের ও মায়ের খরচপাতি চালাত। মীশাই খুব দীনদার ও মাতৃভক্ত হয়। তার বয়স বেড়ে ও দুর্বল হয়ে গেলে লাকড়ি যোগাড় করা তার জন্য কষ্টসাধ্য হল। একদিন তার মা তাকে বলল, তোমার বাবা তোমার জন্য অমুক জঙ্গলে একটি গরুর বাছুর আমানত হিসেবে আল্লাহর জিম্মায় রেখে গেছেন। তুমি সেই বনের ধারে গিয়ে ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুব এর আল্লাহর নাম ধরে ডাক দাও আর দোয়া কর, যাতে বাছুরটি তোমার কাছে ফেরত দেন। গরুটির একটি চিহ্ণ হচ্ছে তুমি যদি গরুটির দিকে তাকাও তাহলে মনে হবে তার চামড়া থেকে সূর্যের কিরণ ঝিলিক দিয়ে বের হচ্ছে।

তার সৌন্দর্য, লাবণ্য ও হলুদাভ চামড়ার উজ্জ্বলতার জন্য লোকেরা একে মাযহাবা (স্বর্ণালি) নামে আখ্যায়িত করে।

তখন যুবক সেই বনের ধারে আসে। দেখে যে, গরুটি চরতে আছে। মায়ের কথা মতো সে ডাক দিল, হে গরু! আমি তোমাকে ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের আল্লাহর নামে শপথ দিয়ে ডাকছি। ডাক শোনামাত্র গরুটি তার সমানে এসে দাঁড়াল।

যুবক গরুটির গলায় ধরে বাড়ির দিকে চলল। এ সময় আল্লাহর হুকুমে গরুর জবান খুলে যায়। সে বালকের সঙ্গে কথা বলে, হে যুবক! হে মায়ের অনুগত সন্তান। তুমি আমার পিঠে চড়। এটা তোমার জন্য সহজ। যুবক বলল, আমার মা আমাকে এর হুকুম দেননি; বলেছেন, একে গলায় ধরে নিয়ে এসো। তখন গাভী বলল, বনি ইসরাইলের খোদার কসম দিয়ে বলছি, তুমি যদি মায়ের কথার ব্যত্যয় করে আমার পিঠে চড়ে বসতে তাহলে কোনো দিন আমাকে তোমার বশে নিতে পারতে না। এখন চলো যাই। তোমার অবস্থা হলো, তুমি যদি পাহাড়কেও হুকুম দাও যে, গোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে এসো এবং আমার সঙ্গে চলো তাহলে তোমার মায়ের যে খেদমত তুমি কর তার কারণে পাহাড় তোমার হুকুম মানতে বাধ্য হবে। অতপর যুবক গাভীটি সাথে নিয়ে চলল। পথিমধ্যে দেখা দিল অন্য রকম বিপত্তি। আল্লাহর দুশমন ইবলিস একজন রাখালের বেশ ধারণ করে এসে বলল, হে যুবক! আমি একজন গরুর রাখাল। পরিবার পরিজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে আমি বাড়ি যাচ্ছিলাম। আমার গরুর পাল থেকে একটি ষাঁড় নিয়েছিলাম আর তার পিঠে আমার মাল-সামানা বোঝাই করেছিলাম। অর্ধেক পথ আসার পর আমি যখন প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার জন্য একটু দূরে যাই, ষাঁড়টি অবাধ্য হয়ে পাহাড়ের মাঝখানে চলে গেছে। তাকে ফিরিয়ে আনার কোনো উপায় এখন নেই। আমার তো এখন প্রাণে মরার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তুমি চাইলে আমাকে যদি তোমার গাভীর পিঠে সওয়ার হতে দাও তাহলে বড় অনুগ্রহ হয়। যুবক সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলল, যাও চেষ্টা কর আর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল কর। আল্লাহ তাআলা যদি তোমার মধ্যে সততা দেখতে পান তাহলে কোনো মাল-সামানা বাহন ছাড়াই তোমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন। ইবলিস তাকে বলল, তুমি যে দামই নির্ধারণ কর, আমি সেই দামে গাভীটি কিনে নেব। আমাকে যদি এই ষাঁড়ের উপর সওয়ার হতে দাও এর মতো দশটি গরু তোমাকে আমি বিনিময়ে দিব।

যুবক পরিষ্কার বলে দিল, আমার মা আমাকে এসব কাজ করার হুকুম দেননি। এসব কথাবার্তা বলার ফাঁকে একটি পাখি তার সামনে দিয়ে উড়ে গেল, তখন গাভীটি তার হাত থেকে পালিয়ে একদম মরুভূমিতে চলে গেল। রাখালও তখন অদৃশ্য হয়ে গেল। যুবক আবার ইবরাহীম (আ.) এর প্রভুর নাম ধরে ডাক দিল। গাভী তার কাছে ফিরে এলো। আল্লাহর কুদরতে গাভীর আবারও জবান খুলে গেল। বলল, হে মাতৃভক্ত যুবক! তুমি কি উড়ে আসা পাখিটির দিকে লক্ষ্য করনি। সে আল্লাহর দুশমন ইবলিস। আমাকে সে ছিনিয়ে নিয়েছিল। তুমি যদি তাকে আমার পিঠে সওয়ার করাতে তাহলে আমাকে তোমার বশে রাখতে পারতে না। তুমি যে মুহূর্তে ইবরাহীমের খোদার নামে ডাক দিয়েছ তখন একজন ফেরেশতা এসে আমাক ইবলিসের হাত থেকে মুক্ত করেন। আর মায়ের প্রতি তোমার ভক্তি ও খেদমতের কারণে আমাকে তোমার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

এই ঘটনার পর যুবক গরুটি তার মায়ের কাছে নিয়ে আসে। মা তাকে বলে, তুমি তো বাবা দরিদ্র। তোমার ধন সম্পদ নাই। দিনের বেলা বন থেকে লাকড়ি এনে বাজারে বিক্রি করা, আবার রাত জেগে ইবাদত বন্দেগী করা তোমার জন্য খুবই কষ্টকর। তুমি গরুটা নিয়ে বাজারে বিক্রি কর আর তার দাম দিয়ে তোমার দিন গুজরান কর। যুবক বলল, মা আপনি বলে দিন, এই গরু কততে বিক্রি করব? মা বললেন, তিন দিনার। তবে শর্ত থাকবে আমার সম্মতি পেলেই বিক্রি কার্যকর হবে। কাজেই দামদর করার সময় আমার অনুমতি সাপেক্ষ বলে উল্লেখ করবে। ওই সময় গরুর সাধারণ দাম ছিল তিন দীনার। যুবক গাভী নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এ সময় আল্লাহ পাক একজন ফেরেশতা পাঠালেন আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে তার কুদরতের কত রহস্য নিহিত তা দেখিয়ে দেয়ার জন্য। সঙ্গে ছেলেটির কাছ থেকে মাতৃভক্তির পরীক্ষা নেয়াও উদ্দেশ্য। অথচ আল্লাহ তাআলা সব ব্যাপারে সম্যক অবগত আছেন।

ফেরেশতা মানুষের সুরতে ক্রেতা সেজে যুবকের কাছে এসে বলল, তোমার গাভীর দাম কত। যুবক বলল, আমার গাভীর দাম তিন দীনার; তবে বিক্রি করার আগে আমার মায়ের অনুমতি নিতে হবে।

তার অনুমতি পেলেই দামদর সাব্যস্ত হবে। ফেরেশতা বলল, ঠিক আছে আমি তিন দীনারের জায়গায় ছয় দীনার দেব। তোমার মায়ের অনুমতি নিতে যেও না। যুবক বলল, আপনি যদি এই গাভীর চামড়া ভর্তি স্বর্ণও দেন তবু আমার মায়ের অনুমতি ও সম্মতি ছাড়া আমি আমার গাভী বিক্রি করব না। অতপর যুবক গাভীটি তার মায়ের কাছে নিয়ে গেল। মা বলল, পরের দিন বাজারে যাও। বল যে, এই গাভীর দাম ছয় দীনার; তবে দামদর তখনই চূড়ান্ত হবে যখন আমার মায়ের অনুমতি পাব। সেদিনই আগের দিনের ক্রেতা পুনরায় এসে বলল, যুবক! আমি তোমাকে এর দাম ছয় দীনারের স্থলে বার দীনার দেব; তবে তুমি তোমার মায়ের সাথে পরামর্শ করতে পারবে না। যুবক তাতে রাজি হল না। সে বাড়ি ফিরে ঘটনাটি মাকে বলল।

মা বলল, বাবা যে লোক তোমার কাছে আসেন তিনি মানুষ নন, ফেরেশতা। মানুষের আকৃতি ধারণ করে তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য আসেন। এবার যখন তিনি তোমার কাছে আসবেন, তুমি তার কাছে জিজ্ঞাসা করবে, আমি কি আমার এই গাভী বিক্রি করব নাকি করব না? আপনার অভিমত আমি জানতে চাই। যুবক পরদিন তাই করল। ফেরেশতা তখন তাকে বললেন, তুমি গাভীটি তোমার মায়ের কাছে ফিরিয়ে নাও। তাকে বল, যেন গাভীটির হেফাযত করে। কারণ বনি ইসরাইল বংশে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটবে তার তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য আল্লাহর নবী হযরত মূসা ইবনে ইমরান এই গরু খরিদ করবেন। তখন তুমি এই গাভী তার চামড়া ভর্তি স্বর্ণমুদ্রার চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করবে না। (অসমাপ্ত)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত