সবুজ-শ্যামল বনপ্রান্তর। পাখিদের কুজন কাকলীতে মুখরিত প্রকৃতি। একটি পাখি উড়তে উড়তে এক ঝোপের কাছে দেখে মাটিতে দানা ছড়ানো। পাশে ঝোপের ভেতর লুকিয়ে আছে এক শিকারি। শিকারি মাথায় ও গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে একেবারে বক ধার্মিক। পাতানো জালে পাখিরা এসে কখন বসে ধরা পড়ে সে অপেক্ষায়।
পাখি ডিগবাজি খেয়ে একটি চক্কর দিয়ে এসে শিকারিকে জিজ্ঞেস করে, লোকালয় ছেড়ে গাছ-গাছালির জামা গায়ে এখানে কীসের তপস্যা করেন? শিকারি জবাব দেয়, সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত আমি একজন সাধক ও সংসারত্যাগী। সংসার ছেড়ে আজ উদাসীন বৈরাগী। সমাজের প্রতি বিরক্ত। তাই গাছ-গাছালির মাঝে কৃচ্ছ্রতা সাধনার জীবন বেছে নিয়েছি।
জুহদ ও তাকওয়া রা গুজিদম দিন ও কিশ
জাংকে মি দিদাম আজল রা পিশে খিশ
সংসার বিরাগী তাকওয়ার জীবন নিয়েছি ধর্মকর্মরূপে
কেননা, মরণকে দেখেছি আমি বহুবার সম্মুখে।
জীবন-মরণের রহস্য আমি উদ্ঘাটন করতে পেরেছি। আমার জীবন আছে, তার মানে একদিন আমাকে মরতে হবে। প্রতিবেশী বন্ধুমহল আপনজনদের অনেকেই চিরবিদায় নিয়েছে। চোখের সামনে মৃত্যুর পারাপার পার হয়ে পরকালে পাড়ি দিয়েছে। আমাকেও একদিন যেতে হবে। এই চেতনায় আয়-উপার্জনের পথ ছেড়ে দোকানপাট গুটিয়ে মৃত্যুর প্রস্তুতিতে বৈরাগ্য সাধনা শুরু করেছি। মৃত্যুর পর দীর্ঘ কবর জীবনে একাই তো থাকতে হবে। তাই দুনিয়ায় থাকতেই আল্লাহকে পাওয়ার সাধনায় একাকিত্বের অভ্যাস করছি। একদিন মৃত্যুর বিছানায় আমার মুখের দুই পাটি চাপিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে। সে কথা মনে আসাতে মৃত্যুর মহড়া দিচ্ছি। কম কথা বলা, কম খাওয়ার অভ্যাস গড়তে হবে জীবনে সিদ্ধি লাভ করতে হলে। একদিন প্রত্যেককে মাটির বুকে ফিরে যেতে হবে। কাজেই আগেভাগে মাটির সঙ্গে মিশে থাকার চেষ্টা থাকা চাই। তাই নারী-পুরুষের কোলাহল ছেড়ে প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিয়েছি।
একটা বিষয় ভেবে দেখ, জন্মের আগে থেকে চারটি উপাদনের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়তা মাখামাখি। মাটি, আগুন, পানি, বাতাসের সংযোগে তৈরি দেহে মানুষের অধিবাস। পরস্পরবিরোধী এসব উপাদানের মাঝে মানুষ বছরের পর বছর জীবন কাটায়। মানুষের আসল তার রুহ। আদি বাসস্থান আলমে আরওয়াহ (রুহের জগত) থেকে মর্ত্যে এসে বাসা বেঁধেছে রুহ। রুহের সৃষ্টি নুর বা জ্যোতি থেকে। জ্যোতির্ময় জগতের রুহ এখানে এসে উপাদান চতুষ্টয়ের কারাগারে বন্দি। দেহ ও বস্তুর চাহিদা পূরণে তার আজ বেহাল দশা। এখানে থাকতে থাকতে রুহ তার জ্যোতির্ময় পরিচয় ভুলে গেছে। রুহের জগৎ থেকে ক্ষণে ক্ষণে বার্তা আসে মাটির জিন্দানে বন্দি মানুষের কানে। কিন্তু সে বার্তা মানুষ শুনতে পায় না। কারণ সে চার দিনের দুনিয়ায় মন্দলোকদের সঙ্গে মিশে জ্যোতির্ময় জগতের বন্ধুদের কথা ভুলে আছে। তার অবস্থা এখানে আত্মভোলা শিশুর মতো।
কুদকান গরছে কে দর বাজি খোশান্দ
শব কশানশান সুয়ে খানে মি কশন
শিশু যদিও মত্ত মগ্ন থাকে দিনমান খেলাধুলায়
সন্ধ্যা নামলে বড়রা এসে অগত্যা ঘরে নিয়ে যায়।
শিশু কিশোররা খেলায় মত্ত থাকে। খেলা ছাড়া কোনো দিকে হুঁশজ্ঞান থাকে না; কিন্তু সন্ধ্যা নামলে তো খেলা শেষ হয়ে যায়। অভিভাবকরা এসে হাত ধরে আপন আপন ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। দুনিয়ার খেলতামাশায় মত্ত মানুষের জীবনেও সন্ধ্যা নামে। তখন বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হয় আসল ঠিকানায়, মাটির বিছানায়। এই বিধান শ্মাশত অমোঘ। খেলার সময় শিশু কিশোররা পায়ের জুতা, গায়ের জামা খুলে রাখে। তারা খেলায় যখন ঘোর মত্ত হয়ে যায়, সুযোগ বুঝে চোর তাদের জামাকাপড় জুতাটুপি বগলদাবা করে চম্পট দেয়। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরিয়ে নিতে বড়রা খেলার মাঠে আসে। তখন যার জামা-জুতা চুরি হয়েছে, সে দেখে তার জামাকাপড় নেই। বাড়ি ফিরতে পারে না, লজ্জা পায়। দুনিয়া নিয়ে মত্ত মানুষের অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। চোর নিজেই তাদের দুনিয়ার খেল-তামাশার মত্ততায় ভুলিয়ে রাখে। তারপর তাদের ঈমান ও তাকওয়ার জামা-জুতা চুরি করে নিয়ে যায়। সেই চোর বড়চোর। সৃষ্টির শুরু থেকেই সে মানুষের শত্রু।
নাই শেনিদি ইন্নামাদ দুনয়া লাইব
বাদ দাদি রখত ও গাশতি মুরতাআব
শোনোনি কি এই বাণী দুনিয়া হলো খেলতামাশা
ঈমানের পুঁজি হারিয়ে তোমার অস্থিরতা হতাশা।
দুনিয়াকে যে খেলতামাশা বললাম, তা কোরআনের সুরা হাদিদের ২০ নম্বর আয়াতে আছে। অতএব, তুমি সতর্ক হও। দুনিয়ার মত্ততায় আত্মভোলা হইও না।
পিশ আজ আঁনকে শব শওয়াদ জামে বজু
রুজ রা জায়ে মকুন দর গুফতগু
রাত আসার আগেই খোঁজে নাও জামা-জুতা
দিনকাল বরবাদ করো না কথাবার্তায় অযথা।
শিকারি বুঝিয়ে বলল, দীর্ঘকাল আমি দুনিয়ার মাঝে কাটিয়েছি। আমার অর্ধেক জীবন নষ্ট হয়েছে বন্ধুদের তোষামোদ ও প্রশংসায় মজে। বাকি অর্ধেক জীবন গেছে শত্রুদের প্রতি রাগ ও দুশ্চিন্তার মাঝে। আমার জুব্বা আচকান নিয়ে গেছে বন্ধুরা। মাথার টুপি ছিনিয়ে নিয়েছে শত্রুরা। আমার অবস্থা খেলায় মত্ত শিশুর মতো। আমি ছিলাম আত্মভোলা। তাই সব ছেড়ে শেষ পর্যন্ত বনপ্রান্তরে আশ্রয় নিয়েছি মুক্তির সন্ধানে।
নেক শবানগাহে আজল নজদিক শুদ
খাল্লে হাজাল লাব বস্সাক লা তাউদ
মৃত্যুর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে জীবনের বাড়িতে
ছাড়ো খেলতামাশা ক্ষান্ত হও যেও না সেদিকে।
হিন সওয়ারে তওবা শো দর দুজদ রস
জামাহা আজ দুজদ বেসতান বাজ পস
সওয়ার হও তওবার বাহনে চোরকে পাকড়াও করতে
তোমার জামাজুতা ছিনিয়ে নাও চোরের কাছ থেকে।
তোমার তওবা যদি খাঁটি হয়, যদি সত্য ও সুন্দরের পথে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত অবিচল হয়, তাহলে ছিনতাই হওয়া ঈমান ও তাকওয়া ফিরিয়ে আনতে তুমি সক্ষম হবে। যে তওবার বাহনের কথা বললাম, তাকে নভোযানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তওবার নভোযানের বিস্ময়কর শক্তি, তার গতি ধারণা অনুমানের বাইরে।
মরকবে তওবা আজায়েব মরকবাস্ত
বরফলক তাজদ বেইয়ক লাহজা জে পস্ত
তওবার বাহন বড় বিস্ময়কর এক নভোযান
অধঃপতন থেকে মুহূর্তে পাড়ি দেয় আসমান।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত অধঃপতিত অনেক মানুষ তওবার নভোযানে সওয়ার হয়ে এক মুহূর্তে আল্লাহর অলিতে পরিণত হয়েছে। তবে এই নভোযানকে সযত্ন পাহারায় রাখতে হবে। যে তোমার জামা-জুতা চুরি করেছিল সে যেন তওবার খেয়াযানের ক্ষতিসাধন করতে না পারে, ঈমান ও তাকওয়ার পাথেয় যেন ছিনতাই করতে না পারে। এর জন্য পাহারা বসাতে হবে প্রতিমুহূর্তে দমে দমে শ্বাস-প্রশ্বাসে। কারণ তোমার ঈমান ও তাকওয়া হরণের কারসাজিতে সে বহুরূপী। তার চরিত্র বনছাগল চোরের মতো।
এক ব্যক্তির একটি বুনো ছাগল ছিল হৃষ্টপুষ্ট। গলায় রশি দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কোথাও। এক চোর পেছন থেকে তাকে অনুসরণ করে। এক ফাঁকে গলার রশিটা কেটে বুনো ছাগলটা নিয়ে পালিয়ে গেল। মালিক টের পেয়ে এলোপাতাড়ি দৌড়াতে লাগল ডানবাম না দেখে। কিছুদূর গিয়ে এক কূপের ধারে দেখে এক লোক বসে কাঁদছে। লোকটি বুক চাপড়িয়ে কাঁদছিল আর্তনাদ করে। তার কথা, আমি সব হারালাম হায় আল্লাহ। ছাগলের মালিক তার কাছে গিয়ে সমবেদনার সুরে জানতে চায় তার বিপদের কথা। লোকটি বলল, আমার থলেতে ছিল একশ দিনার স্বর্ণমুদ্রা। থলেটি পড়ে গেছে এই কুয়ায়। কিন্তু শারীরিক কারণে আমি কুয়ায় নেমে থলিটা তুলতে পারছি না। যদি তুমি তুলে দিতে পার ১০০ দিনারের মধ্যে দশভাগের এক ভাগ দশটি দিনার সানন্দে তোমাকে দিয়ে দেব। ছাগলের মালিক হিসাব করে, দশ দিনার দিয়ে তো দশটি ছাগল কেনা যাবে। কাজেই ছাগলের পেছনে না দৌড়ে কুয়া থেকে দিনারের থলেটা তুলে আনা সাশ্রয়ী হবে। দিনারের লোভ তাকে অন্ধ করে দিল। কাপড় খুলে সে কুয়ায় নামল। সেই সুযোগে কান্নারত চোরটি তার কাপড় ও মালপত্র নিয়ে আবারও চম্পট দিল। এই চোর বড় ফিতরাবাজ। প্রতি মুহূর্তে মনের খেয়াল যেভাবে পাল্টায় সেই চোরও চোখের পলকে তার রূপ বদলায়। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া এই চোরের খপ্পড় থেকে রক্ষা পাওয়ার সাধ্য কারও নেই।
কস নদানদ মকরে উ ইল্লা খোদা
দর খোদা বোগরিজো ওয়ারেহ জান দাগা
আল্লাহ ছাড়া জানে না কেউ তার ধোঁকার ধরন
তার ধোঁকা থেকে বাঁচতে চাইলে নাও আল্লাহর স্মরণ। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : বয়েত : ৪৩৫-৪৭৭)।
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)