প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১২ জুলাই, ২০২৫
আমাকে কে হত্যা করতে পারে প্রেম ছাড়া? কিন্তু প্রেমের হাতে নিহত হলে আমি তো নিহত হই না। জীবনের নতুন অর্থে প্রবেশ করি। মৃত্যু আমাকে মারতে পারে না, এটা তো চূড়ান্ত। মরণের মারণে মরে না মানুষ। সে স্থানান্তরিত হয় মাত্র। এক জগৎ থেকে আরেক জগতে যায়। কিন্তু যে জগতেই যাক, মানুষের আত্মা খুঁজে বেড়াচ্ছে পরম মোক্ষ, সে নিহিত আছে প্রেমে।
বিচার-বুদ্ধি, যুক্তি ও প্রজ্ঞার সকল বয়ান আমরা শুনি। তারা আমাদের পথ দেখায়। মশালের মতো। প্রদীপের মতো। তারা বলে এই দেখো, সত্য এবং এগিয়ে যাও। কিন্তু সত্যের যে পথ, তার মর্মমূলে নিহিত আছে প্রেম। সুফিরা বলেন প্রেম দুই রকম-
১. বাহ্যিক বা দৈহিক প্রেম : এর মানে হচ্ছে যা কিছু দৃশ্যত ও বাহ্যত আকর্ষণীয়, সুন্দর তার প্রতি মুগ্ধ টান, আকর্ষণ।
২. অভ্যন্তরীণ বা প্রকৃত প্রেম : যেহেতু যা কিছু সুন্দর তাই আল্লাহতায়ালার জামাল ও কামালের (সৌন্দর্য ও পূর্ণতার) তাজাল্লি (বিকীরণ), সেহেতু বাহ্যিক প্রেম অতিক্রম করে প্রকৃত প্রেমের স্তরে উপনীত হওয়া সম্ভব।
প্রেম হচ্ছে আধ্যাত্মিক তৎপরতার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সত্তাকে বিশোধনের একটি পদ্ধতি। হৃদয় বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন হওয়ার পর আল্লাহতায়ালার নুর বা আলো গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত হয়। হৃদয় যখন এমন একটি আয়নায় পরিণত হয়, যাতে আল্লাহতায়ালার কুদরতের বহিঃপ্রকাশসমূহ প্রতিফলিত হয়, তখন তাতে প্রকৃত বাস্তবতা তথা সত্য মুদ্রিত হয়ে যায় এবং তাতে সুস্পষ্ট হাকিকতে প্রবেশ করে মানুষ। সে নিজের মধ্যে আল্লাহর রহস্যসমূহকে আবিষ্কার করে এবং তার সঙ্গে সম্পর্কসূত্রকে জীবন্ত করে। এই সম্পর্কসূত্র হচ্ছে মানবেসত্তার চিরায়ত আমানত।
মহাকবি হাফিজ বলেছিলেন, ‘যে আমানতের বোঝা আসমান বহন করতে পারেনি তার ব্যাপারে ভাগ্য পরীক্ষার লটারিতে আমার মতো পাগলের নাম উঠল।’ হ্যাঁ, মানুষই এই নিখিলে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব, আনুগত্য ও দায়িত্বের আমানত বহন করছে। এর বহিরাঙ্গণে আছে শরিয়ার শৃঙ্খলা, ভেতরে আছে জাগ্রত খোদাপ্রেম।
খোদার ভালোবাসার ভাবাবেগ যখন মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়, তখন চিন্তা ও কর্মের সকল শাখা-প্রশাখা তাঁরই রঙে রঙিন হয়ে যায়। জীবনের কোনো গলি বা গোপন কোণও তাঁর আওতার বাইরে থাকে না। কিছু দিকের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে।
এক. খোদায়ি ভালোবাসার সবচেয়ে গভীর প্রভাব মানুষের জীবনে কেন্দ্রিকতা সৃষ্টি করে। এই কেন্দ্রিকতা প্রতিপালন-ব্যবস্থার একটি মহিমা এবং খোদার একত্বের ওপর নিখুঁত বিশ্বাসের একটি অপরিহার্য ফলাফল। শিরক মানুষের চিন্তা ও কর্মের কেন্দ্রিকতাকে ধ্বংস করে। অতএব, এর চেয়ে গুরুতর কোনো মানবীয় পাপ হতে পারে না। এরপর যে জিনিস সেই কেন্দ্রিকতাকে সুগঠিত করে, ঈমানের আসল মহিমা, অটুট করে এবং প্রকৃত অর্থে উজ্জীবিত করে, তা হলো মুহাব্বত ও ভালোবাসা।
দুই. যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সত্যিকার ভালোবাসার সম্পর্ক রাখে, সে সর্বদা নিজেকে তার সান্নিধ্যের অনুভবের মধ্যে আবিষ্কার করে। খোদার উপস্থিতির নিশ্চয়তা এমনভাবে হয়, যেন পরমকে তিনি নিজের চোখে দেখছেন। কবি ও সুফি মির খুরদ (রহ.) নিজামুদ্দিন আউলিয়া সম্পর্কে লিখেছেন যে, ‘তিনি এই মনোভাব নিয়ে আল্লাহর দিকে অভিমুখী থাকতেন যেন তিনি তাকে দেখছেন।’ যখন একজন ব্যক্তি আল্লাহতায়ালাকে এইভাবে অনুভব করতে শুরু করে, তখন তার জীবনে
সমস্ত পাপ রুদ্ধ হয়ে যায়। সে পাপ করতে সক্ষমই থাকে না, ‘বিচার দিবসের মালিকের’ দরবার সর্বদা তার চোখের সামনে থাকে। তিনি তার প্রিয়তমের উপস্থিতির অনুভবে এতটাই নিমজ্জিত হয়ে যান যে, পাপ করার ফুরসতই তার মেলে না। শেখ আলি হুজবিরি (রহ.) লিখেন, ‘কেবলমাত্র আল্লাহ দেখছেন এই জাগ্রত চেতনা মানুষকে পাপ থেকে বিরত রাখে।’ (কাশফুল মাহজুব : ১০)।
যখন একজন ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে জানবে যে, খোদা তাকে দেখছেন, তখন তিনি কখনোই সে কাজ করবেন না, যা খোদার সামনে তাকে লজ্জিত করবে, অপরাধী করবে।
তিন. আল্লাহর প্রেম যখন সম্পূর্ণরূপে প্রাধান্য পায়, তখন তা মানুষের ওপর পার্থিবতার আধিপত্য থাকে না । তা কমতে কমতে মানুষের চোখে সোনা এবং পাথর বরাবর হয়ে যায়। (হুজ্জাতুল্লাহ আল-বালিগা, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১৬৮)। জড় জগতের আকর্ষণ তার জন্য অকার্যকর হয়ে উঠে। জুনাইদ বাগদাদি (রহ.) এক রাতে আবদার করেন যে, হে আল্লাহ আপনি আমাকে বলে দিন বেহেশতের মধ্যে আমার বন্ধু ও সঙ্গী কে হবেন? আওয়াজ এলো, ওমুক রাখাল তোমার সঙ্গী।’ জুনাইদ বাগদাদি (রহ.) সেই রাখালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং কয়েক দিন ধরে তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার পর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়েন, এছাড়া এমন কোনো কাজ করেন না। তাহলে কীসের দ্বারা এতো উচ্চস্থান অর্জন করলেন? সম্ভবত এই উচ্চ অবস্থান অধিকার করেছেন কোনো গোপন গুণের কারণে।
রাখাল বলল, খাজা জুনায়েদ, আমি একজন অজ্ঞ মানুষ। কৃতিত্ব কাকে বলে আর গোপন কি জিনিস, আমি জানি না। তবে আমার দুটি গুণ
আছে। একটি হলো আল্লাহ যদি এই সব পাহাড়কে সোনায় পরিণত করেন এবং সেগুলোর মালিক আমি হই, তাতে উল্লসিত হবো না। সেগুলো যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তাতে ব্যথিত হবো না। দ্বিতীয়টি হলো, কেউ আমার প্রতি রাগ করলে মনে করি এর পেছনে আছে আল্লাহর ইচ্ছা। দয়া করলেও মনে করি তা আসলে আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘটেছে। প্রতিটি ব্যাপারকে আমি এভাবেই দেখি। (আল মাজালিস, কলমি নোসখা, মজলিসে হাফতুম, উর্দু অনুবাদ : ২৭)। মানুষের উপলব্ধিজগতের এই সব মাত্রা খোদায়ি ভালোবাসা থেকে উদ্ভূত হয়।
চার. আল্লাহর ভালোবাসা এমন একপর্যায়ে যায় যেখানে সুফি মনে করেন, ‘আমি আমার তাবৎ বিষয়কর্ম আমার রবের কাছে অর্পণ করেছি, তিনি চাইলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন, চাইলে জীবন ছিনিয়ে নিন। তিনি যেমনটি চান, আমি ঠিক তাতেই খুশি। এমনতরো উপলব্ধি মানুষের মধ্যে ভরসা ও ইসতিগনার এক অদ্ভুত অবস্থা তৈরি করে। দুনিয়ার জাঁকজমক, ধন-দৌলতের জন্য সে মোটেও পেরেশান থাকে না। বলে, আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নয়?
আল্লাহর রবুবিইয়তের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস মানুষকে তার উপার্জনের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়।
তিনি আল্লাহর প্রতিশ্রুতির প্রতি পূর্ণবিশ্বাস রাখেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি হলো, যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য পথ বের করে দেন। আল্লাহ তার জন্য এমন জায়গা থেকে রিজিক প্রদান করবেন, যেখানে কারও কল্পনাও পৌঁছায় না। আল্লাহর ওপর ভরসাকারী ব্যক্তির জন্য আল্লাহ যথেষ্ট।’ সে উপার্জনের জন্য কোনো অন্যায্য পথকে প্রশ্রয় দেয় না মোটেও।
মানুষের চরিত্রের বিকাশ ও গঠনে, তার আয়-উপার্জনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উপার্জনের পথসন্ধানে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুল করে। কোনো পার্থিব শক্তির মুখাপেক্ষিতা তার চরিত্রে অত্যন্ত মারাত্মক প্রভাব ফেলে। খোদাপ্রেম তা থেকে উত্তরণ দেয়। আত্মণ্ডনির্মাণ ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ না একজন ব্যক্তি তার সমস্ত ইমানি প্রত্যয়ের সঙ্গে মহান আল্লাহকে তার জীবিকানির্বাহী হিসেবে গ্রহণ করবে না।
সারকথা হলো, মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা জাগ্রত হলে তার জীবনের ধরন পাল্টে যায়। চিন্তা ও কর্মের সমুন্নতি ঘটে, সৃষ্টির সেবা, ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যতার মতো অসংখ্য গুণাবলি এই আবেগের নদীস্রোতে তরঙ্গিত হয়।