মুড়ির টিন বাস। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগেও শ্রমিক পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে জরাজীর্ণ, টিনে মোড়ানো এক ধরনের পুরোনো বাস। স্থানীয়দের ভাষায় এটি হলো মুড়ির টিন বাস।
আমাদের দেশে সড়কপথে প্রথম দিকের গণপরিবহন ছিল এই মুড়ির টিন বাস। গতকাল রোববার দুপুরে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার ব্রিজে দেখা মিলল জরাজীর্ণ, টিনে মোড়ানো মুড়ির টিন নামের এই পুরোনো বাসটির। বাসটি ঢাকার ধামরাইয়ের একটি সিরামিক কারখানায় শ্রমিক পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাসের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল সাটুরিয়া বাজারের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম। বাসের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, এরকম বাস তো আগে দেখিনি, তার মতো আরও কয়েকজনকে দেখা গেল বাসের কাছে গিয়ে বাসটিকে দেখতে।
জানা গেছে, বাসের নাম মুড়ির টিন হওয়ার পেছনে রয়েছে এক অদ্ভুত কারণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমাদের অঞ্চলের মিত্রবাহিনীদের ব্যবহার করা যানবাহন এদেশের বিত্তশালীদের কাছে বিক্রি করা হয়। এসব যানবাহনের মধ্যে ছিল ট্রাক, জিপ গাড়ি ইত্যাদি। এগুলো ছাড়াও ভাঙাচোরা কিছু গাড়িও বিক্রি করা হয়।
এগুলো গাড়ির ছিল কাঠের বডি। বিত্তশালীরা এসব কাঠের বডির গাড়িকে নাকবোঁচা বাসের আদলে মেরামত করত। ইঞ্জিন আমদানি করা হতো যুক্তরাজ্য থেকে। অনেক সময় কাঠের বডি স্থানীয় মিস্ত্রিরাও তৈরি করত। কাঠের বডির উপরে মুড়ে দেয়া হতো টিন। নৌকার ছাউনির মতো করে বাসের উপরে টিনের ছাউনি দেয়া হতো যেন বৃষ্টি এলে যাত্রীরা ভিজে না যায়। বাসের ভেতরে চারধারে বেঞ্চের মতো করে সিট বসানো হতো। ২০-২২ জন বসার সুযোগ পেত। ৫০ জনের বেশি যাত্রী দাঁড়িয়েই থাকত। জানালার পুরোটাই খোলা যেত বলে বাতাস চলাচলের সুযোগ ছিল বেশি। মূলত এ থেকেই বাসগুলোর নাম হয়ে যায় মুড়ির টিন বাস।
আবার অনেকে বলে বাসে মুড়ির মতো ঠেসে যাত্রী ঢোকানো হতো বলে এই বাসের নাম হয়ে যায় মুড়ির টিন। ৬০,৭০ ও ৮০ দশকে বেশি চলত মুড়ির টিন বাস। ২৫ বছরের পুরোনো গাড়ির ফিটনেস বাতিল করা হলে সেই থেকে মুড়ির টিন বাস প্রায় উঠে যায়।
কালের বিবর্তনে এই ঐতিহ্যবাহী মুড়ির টিন বাস হারিয়ে গিয়েছে। এখন লোকাল পরিবহনেও এসি বাসের দেখা পাই আমরা। প্রযুক্তির বিকাশে পুরাতনকে হটিয়ে নতুনরা স্থান করে নিবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই আমাদের আগের প্রজন্মের যারা মুড়ির টিন বাসে চড়েছেন, তারা এ গাড়িটি দেখলে স্মৃতিকাতর হবেন নিশ্চয়ই।
বাসটির হেলপার রতন জানান, গাড়িটি যেখানে যায় সেখানে লোকজন গাড়িটিকে দেখতে আসে আমার কাছে বিষয়টি ভালো লাগে, খুশি লাগে। লোকজন গাড়িটি দেখলেই অনেক কিছু জিগায়।
বাসের চালাক সেলিম হোসেন জানায়, গত দুই বছর ধরে বাসটি চালাচ্ছে সে। গাড়িটির বয়স ৮৫ বছর। গাড়িটির আসল নাম সুপরিয়ান বডি তবে গাড়িটিকে মুড়ির টিনও বলা হয়। গাড়িটি নিয়ে যেখানে যাই লোকজন অনেক কিছু জিজ্ঞাস করে ছবি তুলে, ভিডিও করে। অনেক পুরোনো হলেও অন্যান্য গাড়ির তুলনায় ভালো চলে, আগে তৈল দিয়ে চললেও বর্তমানে গাড়িটি চলছে গ্যাসে। এবং অন্য গাড়ির তুলনায় গ্যাসও কম খরচ হয় গাড়িটিতে। বাসটির বিরতিহীন সার্ভিস ছিল, আগে গাবতলী থেকে কালিয়াকৈর চলাচল করত বর্তমানে এটি ধামরাইয়ের সিরামিক কারখানায় শ্রমিক পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে।