ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নকলার চরাঞ্চলে বাড়ছে চীনাবাদামের আবাদ

* চলতি মৌসুমে উপজেলায় ২০৮ একর (৮৪ হেক্টর) জমিতে চীনাবাদাম চাষ করা হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭৭ টন
নকলার চরাঞ্চলে বাড়ছে চীনাবাদামের আবাদ

শেরপুরের নকলা উপজেলার মধ্যদিয়ে বয়েযাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদ, ভোগাই নদী এবং বিভিন্ন নদী-নালার তীরবর্তী এলাকাসহ বেলে মাটির অনাবাদি জমিতে নামমাত্র শ্রমে অধিক লাভবান হওয়ায় চরাঞ্চলের কৃষকরা চীনাবাদাম চাষে লাভবান হচ্ছেন। নদীভাঙন বা বন্যা পরবর্তী অনাবাদি ও বালুময় জমিতে বাদাম চাষ করা হচ্ছে, যা আগে অব্যবহৃত থাকত। ফলে কৃষকরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন এবং পতিত জমির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে। কৃষি বিভাগের পরামর্শ, প্রণোদনা ও উন্নত জাতের চাষাবাদের কারণে বাদাম চাষের বৃদ্ধি ঘটছে। এটি লাভজনক ফসল হওয়ায় কৃষকরা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। ব্রহ্মপুত্রনদ ও ভোগাই নদীসহ বিভিন্ন শাখা নদীর তীরবর্তী অনুর্বর পতিত বেলে মাটির জমিতে অন্যকোন ফসল না হলেও চীনাবাদামের উৎপাদন ভালো হওয়ায় এ ফসল চাষে ঝুঁকছেন কৃষক। এখানকার উৎপাদিত বাদামের দানা অধিক পুষ্ট হওয়ায় চাহিদা বেশি। উপজেলায় দিন দিন বাড়ছে চীনাবাদাম চাষের পরিমাণ ও চাষির সংখ্যা। লাভবান হচ্ছেন উপজেলার চন্দ্রকোণা, চরঅষ্টধর, উরফা, পাঠাকাটা ও বানেশ্বরদী ইউনিয়নের অগণিত চাষি। তবে বেশি চাষ হয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদের চন্দ্রকোণা ও চরঅষ্টধর ইউনিয়নে এবং উরফা ইউনিয়নের ভোগাই নদীর তীরবর্তী এলাকায়।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুুমে উপজেলায় ২০৮ একর (৮৪ হেক্টর) জমিতে চীনাবাদাম চাষ করা হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭৭ টন। উপজেলায় একটিমাত্র প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। প্রদর্শনী প্রাপ্ত কৃষককে ১০ কেজি বীজ, ২০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি ডাই এ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ও ১০ কেজি মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) প্রদান করা হয়েছে।

চীনাবাদাম এদেশে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ তৈলবীজ ফসল। চাষের অনুকূল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে খুব অল্প পরিমাণ জমিতেই চীনাবাদাম চাষ করা হয়। যদিও খাদ্য-পুষ্টি, তেল, পশুখাদ্য, খইল, সার, শিল্পের কাঁচামাল প্রভৃতি বিবিধ উদ্দেশ্যে চীনাবাদাম ব্যবহৃত হয়। অনাবাদি জমিতে, কম পরিশ্রমে, বেশি উৎপাদন হওয়ায় ও দাম চাহিদা অনুযায়ী পাওয়ায় কৃষকরা চীনাাদাম চাষ করে খুশি। এখানকার বাদাম স্থানীয় চাহিদা মিটানোর পরে পাশ্ববর্তী জেলা ও বিভাগীয় শহরে সরবরাহ করা হয়। চাষিরা জানান, বাদাম চাষে শুধুই লাভ। বেলে মাটিতে অধিক তাপমাত্রা, পর্যাপ্ত সূর্যের আলো ও মাঝারি বৃষ্টিপাত পেলে চীনাবাদামের ফলন ভালো হয়। এখানে বিভিন্ন জাতের বাদাম চাষ হলেও মাইজচর বাদাম (ঢাকা-১), বাসন্তী বাদাম (ডিজি-২), ঝিংগাবাদাম (এসসি-১২), বারিবাদামণ্ড৮, ডিএমণ্ড১ এর ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকরা এজাত গুলোই চাষ করেন।

চরঅষ্টধর, নারায়নখোলা, চন্দ্রকোনা, পাঠাকাটা, বানেশ্বরদী, বাছুর আলগা ও উরফাসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বাদাম গাছে ফুল আসা শুরু হয়েছে। বাদাম খেতের সবুজ মাঠের দৃশ্য সবার নজর কাড়ছে, বিশেষ করে শহুরে লোকদের। অনেক অভিভাবক তাদের শিশু সন্তান নিয়ে বিকেল বেলা বাদাম খেত দেখতে যান।

চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের বাছুর আলগা দক্ষিণ পাড়ার কৃষক ইয়াদ আলী ও আব্দুল কাদিরসহ বেশ কয়েকজন কৃষকদের সাথে কথা হলে তারা জানান, যে জমিতে অন্যকোনো ফসল উৎপাদন হয় না, সেই জমিতেই ধানের চেয়েও ভালো দামের ফসল চীনাবাদাম উৎপাদন করছেন কৃষক। প্রতি একর জমিতে চীনাবাদাম উৎপাদন হয় ১৫ মণ থেকে ২০ মণ, যার বাজার মূল্য ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা। তারা জানান, বাদাম খেতে প্রয়োজনে প্রতি একরে ইউরিয়া ৩০-৪০ কেজি, টিএসপি ৮০-৮৫ কেজি, এমওপি ৩৫-৪৫কেজি, জিপসাম ৪৫-৫৫ কেজি প্রয়োগ করলে উৎপাদন ভালো হয়। জমিতে ঘাস হলে জমির ‘জোঁ’ বুঝে দুই একটি নিড়ানি ও জমির প্রকার ভেদে দুই তিনটি সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।

স্থানীয় বাজারের বাদাম ফেরিরা জানান, আগে দূর-দূরান্ত থেকে বাদাম কিনে আনতে হতো। এখন উপজেলায় দিন দিন বাদাম চাষের পরিমাণ বাড়ায় এখন তারা নিজের উপজেলা থেকেই কিনতে পারছেন। তাতে লাভের পরিমাণ বেড়েছে। স্থানীয়ভাবে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারায় পরিবহন খরচ বেঁচে যাচ্ছে, ফলে লাভবান হচ্ছেন ক্রেতা ও কৃষকরা। আগামীতে চাষির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেক কৃষক।

খন্দকার দাওয়াখানার স্বত্বাধিকারী হাকিম খন্দকার জসিম উদ্দিন জানান, চীনাবাদমে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ ভোজ্য তেল পাওয়া যায়। এটি তৈলবীজ হিসেবে সুপরিচিত হলেও এর যথেষ্ট ঔষধি গুণ রয়েছে। এতে শতকরা ২৫-৩৩ ভাগ প্রোটিন, ৪০-৫০ ভাগ চর্বি, ১০-২০ ভাগ কার্বোহাইড্রেট, ২-৩ ভাগ আঁশ, ৭-৮ ভাগ পানি, চুন, ফসফরাস, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘বি’ পাওয়া যায়। তাছাড়া এর খইলে ৪২ ভাগ ক্রুড প্রোটিন, ৭ ভাগ চর্বি, ২০ ভাগ কার্কোহাইড্রেট, ৭-৮ ভাগ নাইট্রোজেন, ১.৫ ভাগ ফসফরিক এসিড এবং ১-২ ভাগ পটাশ থাকে। তাই গবাদিপশু ও মুরগির জন্য এই খইল উৎকৃষ্ট খাদ্য। তাছাড়া বনস্পতি প্রস্তুত, সাবান, সুগন্ধি দ্রব্য, মোম ও বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে বাদাম বীজ ব্যবহার করা হয়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী জানান, উপজেলার অনেক জমি অনাবাদি থাকে। এসব অনাবাদী জমির মধ্যে কিছু বেলে মাটির জমি আছে যেখানে চীনাবাদাম চাষ করা সম্ভব। ওইসব জমিতে বাদাম চাষ করতে পারলে কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সেই লক্ষ্যে নদ-নদীর তীরবর্তী ও অনাবাদি বালুময় এলাকার কৃষকদের বাদামচাষ করতে আগ্রহী করতে নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বালুময় এলাকার যেকেউ পতিত জমিতে চীনাবাদম চাষ করে স্বাবলম্বী হতে পারেন বলে মন্তব্য করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত