
শীতের আগমনের বার্তা নিয়ে যশোরের কেশবপুর উপজেলার গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়েছে খেজুরের রস সংগ্রহের প্রস্তুতি। উপজেলার বাগদহা, প্রতাপপুর, মোমিনপুর, মঙ্গলকোট, মজিদের, হাসানপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের গাছিরা এখন খেজুর গাছ ছাঁটাই ও চাচ দেওয়ার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
কেশবপুরের মানুষ বছরের এ সময়টির অপেক্ষায় থাকে সারা বছর। কারণ শীত মানেই খেজুরের রস, গুড়-পাটালি আর পিঠাণ্ডপায়েসের উৎসব। স্থানীয় গাছি আব্দুল গফুর জানান, প্রথমে ধারালো দা দিয়ে গাছের মাথা ছাঁটাই করা হয়, যাকে তারা ‘ডেগো ছাটাই’ বলে। এক সপ্তাহ পর গাছের সোনালি অংশ বের করে দেওয়া হয়, যেটিকে ‘চাচ দেওয়া’ বলা হয়। এরপর বাঁশের তৈরি নলি বসিয়ে মাটির ভাড় ঝুলিয়ে দেওয়া হয় রস সংগ্রহের জন্য।
তিনি বলেন, ভোরের কুয়াশা আর ঠান্ডা হাওয়া জানিয়ে দেয় রসের সময় এসে গেছে। এখন প্রতিদিন সকালেই আমরা গাছের নিচে ভাড় নামাতে যাই রসের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। রস সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নতুন ধানের চাউল দিয়ে গুড়া তৈরি ও রসের পিঠা বানানোর আয়োজন। খেজুরের রস থেকে তৈরি হয় দানা গুড়, পাটালি গুড় ও তরল গুড় যার সুৃনাম কেশবপুর ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. রমজান আলী জানান, প্রতিবছর শীতের শুরুতেই কেশবপুরের গুড়ের ব্যাপক চাহিদা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গুড় ও পাটালি যায়। এখন অনেকে অনলাইনে অর্ডার দিচ্ছেন বিদেশেও পাঠানোর জন্য।
কেশবপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে উপজেলায় প্রায় ৩৫-৪০ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। প্রতি বছর উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের উদ্যোগে নতুন খেজুর গাছের চারা রোপণ করা হচ্ছে এবং চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
উপজেলার বাগদহা গ্রামের প্রবীণ গাছি আব্দুল জলিল বলেন, আমাদের দাদা-পরদাদারা খেজুর রসের গুড় বিক্রি করে সংসার চালাতেন। এখন রসের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু গাছ কমে যাচ্ছে। গাছ না বাঁচালে ঐতিহ্যও বাঁচবে না।
কেশবপুরের খেজুর রস শুধু খাদ্য নয়, এটি একটি ঐতিহ্য, যা এই অঞ্চলের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম বাংলার প্রতিটি প্রভাতে যখন ভাড় থেকে রস ঝরবে, তখন আবারও জীবন্ত হয়ে উঠবে সেই পুরনো চিত্র খেজুর গাছের নিচে রস বিক্রির ভিড়, গুড়ের গন্ধে ভরে থাকে কেশবপুরের গ্রামগুলো।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, খেজুর গাছ অন্যান্য গাছের মতো সার বা কীটনাশক ছাড়াই বড় হয়। এটি কৃষকদের অতিরিক্ত আয় দেয় এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে স্থানীয়রা জানান, ইটভাটায় খেজুর গাছ পোড়ানো এবং অপরিকল্পিত কাটা বন্ধ না করলে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।