
দেশের অন্যতম ‘চাঁদপুর সেচ প্রকল্প’ এর আওতাধীন সেকেন্ডারি সেচ খালের পরিমাণ ৭৫৪ কিলোমিটার কাগজে থাকলেও বাস্তবে আছে ৪০০ কিলোমিটার। বাকি খাল বিভিন্নভাবে দখল ও ভরাট হয়ে আছে। নির্দিষ্ট সময়ে সেচের অভাবে ফসল উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং অনবাদি হয়ে পড়ছে কৃষি জমি। কৃষকরা বলছে জরুরি ভিত্তিতে খাল সংস্কার ও অবৈধ দখল মুক্ত করতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে সেচ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে খালগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলার ছয়টি উপজেলার প্রকল্পভুক্ত আবাদযোগ্য জমিতে সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাদির মাধ্যমে আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা সেচ প্রকল্প তৈরি করা হয়। প্রকল্পভুক্ত ৫৩ হাজার হেক্টর এলাকা বন্যামুক্ত ও জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা করে সাড়ে ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়।
সরেজমিন কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে সঠিক সময়ে সেচের প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে। বিশেষ করে বোরো আবাদের সময় পানি সংকট দেখা দেয়। ২০২৪ সালে সদর উপজেলার বাগাদি ইউনিয়নের ব্রাহ্মন সাখুয়া গ্রামে পানির অভাবে ৪০ একর জমি অনাবাদি ছিল।
মধ্য বাগাদি গ্রামের কৃষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, সামনে বোরো আবাদ শুরু হবে। গেল বছর মৌসুমের শুরুতে একবার পানি দেওয়ার পর সংকট শুরু হয়। পানি না পাওয়ায় আমাদের জমিগুলো পেটে যায়। স্কিম ম্যানেজার পাম্প না চালিয়ে টালবাহানা করে। একই এলাকার অন্য কৃষক কবির ঢালী বলেন, সঠিক সময়ে পানি পাই না। প্রয়োজন শেষ হলে পানি পাওয়া যায়। তখন অতিরিক্ত পানিতে ধানগাছ নষ্ট হয়ে যায়। সেচ প্রকল্প করা হয়েছে ফসল উৎপাদনের জন্য। কিন্তু সেচ খালে মাচ চাষিরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে। তাদের পানির প্রয়োজনের কারণে পানি নিষ্কাশন বন্ধ থাকে। এসব সমস্যা দূর করতে হবে।
পাশের নানুপুর গ্রামের কৃষক ইব্রাহীম গাজী বলেন, বোরো মৌসুমে নদীতেও পানি কম থাকে। যে কারণে সেচ পাম্পগুলো চালিয়ে কোনো লাভ হয় না। পানির অভাবে আমাদের ধানের চারাগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সদরের বালিয়া ইউনিয়নের দুর্গাদি গ্রামের কৃষক হান্নান গাজী বলেন, গেল বছর সেচ খালের কিছু অংশ সংস্কার হয়েছে। কিন্তু ওই খাল থেকে জমিগুলোতে পানি আসার জন্য সরু খাল স্থানীয় লোকজন ভরাট করে রেখেছে। অনেক সময় লোকজন খালে মাছ ধরার জন্য বাঁধ দেয়। পরে আর ওই বাঁধ অপসারণ না করা হলে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
একই ইউনিয়নের সাপদী গ্রামের কৃষক লেয়াকত হোসেন খান বলেন, সেচ খাল সংষ্কার হলেও প্রধান খালের মুখে ১ হাজার ফুট সংস্কার হয়নি। এছাড়াও খালের বিভিন্ন অংশ ভরাট হয়ে গেছে। অনেকেই বাড়িঘর তৈরি করেছে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে এসব সমস্যা দূর করতে হবে। ফসল উৎপাদনের জন্য সঠিক সময় পানি যেমন প্রয়োজন। তেমনি বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন দরকার হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মো. রহুল আমিন বলেন, কৃষকদের সেচ নিশ্চিত করতে আমাদের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। তবে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কারণ তারা সেচ খালের বিভিন্ন স্থানে মাছ ধরার জন্য বাঁধ দেয়। পরে সেগুলো অপসারণ করা হয় না। আমরা নির্ধারিত সর্বোচ্চ পন্ড লেভেল (২.৪৪ মি.) পানি দিলেও প্রতিবন্ধকতার কারণে পানি খালে প্রবেশ করতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিক থাকলে সব খালে পানি পৌঁছে যাওয়ার কথা।
তিনি আরও বলেন, সেচ প্রকল্প প্রতিষ্ঠার সময় খাল ছিল সাড়ে ৭০০ কিলোমিটার। এখন প্রায় ৪০০ কিলোমিটার খাল সচল রয়েছে। সেচ প্রকল্পের বাগাদি পাম্প হাউজের মেশিনগুলো প্রায় সাড়ে ৪ যুগ আগে বসানো। এগুলো এখন কোনো রকম সংষ্কার করে সেচ চালু রাখা হয়। তবে নতুন করে পাম্প মেশিন বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহরুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর বোরো আবাদের সময় কৃষকরা পানি না পেলে অভিযোগ দেয়। তবে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করি। গেল বছর থেকে খাল সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২৫ কিলোমিটার সংস্কার হয়েছে। এ বছর আরও ৩০ কিলোমিটার সংস্কার হবে। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। জানুয়ারি মাসের মধ্যে পানি দেওয়া শুরু হবে। যদি কোনো এলাকায় সেচ সংকট দেখা দেয়, ওই এলাকায় আমরা তাৎক্ষণিক পানির ব্যবস্থা করব।