ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রবীণকে ভয় দেখানোর সংস্কৃতি

হাসান আলী
প্রবীণকে ভয় দেখানোর সংস্কৃতি

মানুষ ভয় পেতে এবং ভয় দেখাতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। সবচেয়ে বড় ভয়ের নাম মৃত্যু। মৃত্যুকে মেনে নিতে না পারার কারণে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে অধিক কৌতূহলী হয়ে ওঠে। মৃত্যু-পরবর্তী অদেখা জীবন কতটা আনন্দ-বেদনার তার বর্ণনা শুনতে আকুলতা রয়েছে। হারানো স্বজনের সাথে দেখা হবার, সময় কাটাবার নানা স্বপ্ন ব্যক্তিকে উজ্জীবিত করতে সহায়তা করে। মানুষ ঝড় তুফান, শিলা বৃষ্টি, বন্যা, বজ্রপাতসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। অন্ধকার গুহায় বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মৃত্যু হতে পারে এই ভয় মানুষকে অস্থির ও নির্ঘুম করে রাখতো। আগুন আবিষ্কার করে সেই ভয় খানিকটা তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। আমরা এখনো অন্ধকারকে ভয় পাই। অজানা বিষয়গুলো সামনে আসলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। দুর্বল মানুষ অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী মানুষকে ভয় পায়। হিংস্র প্রাণীর ভয়ে লুকিয়ে থাকে কিংবা আত্মগোপনে চলে যায়। ভয় থেকেই মানুষ আত্মরক্ষার জন্য অন্যকে আক্রমণ করে বসে। নিজেকে রক্ষা করতে অস্ত্রশস্ত্র মজুত করে, স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নিয়ে জোট বাঁধে। ভয় পেয়ে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজ করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। বড় শক্তির সাথে, ক্ষমতাবানদের সাথে মৈত্রী গড়ে ভয়মুক্ত থাকার চেষ্টা হচ্ছে। ভয়মুক্ত থাকার জন্য সবসময়ই ক্ষমতা থাকার দরকার হয়। ক্ষমতাবানরা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। ক্ষমতাবানরা যেমন নিজেদের রক্ষা করতে পারে তেমনি তার অনুসারী সেবক, বাদকদের রক্ষা করতে পারে। সে জন্যই মানুষ ক্ষমতা পেতে এতটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ভয় মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দিয়েছে। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার জীবনকে অতি সহজ করে দিয়েছে। আবার বিজ্ঞানের আবিষ্কার পৃথিবী ধ্বংস হবার আশঙ্কা তৈরি করেছে।

আগে যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। সেখানে হাতি, ঘোড়া, তলোয়ার, বর্শা, বর্ম, তীর, ধনুক নিয়ে যুদ্ধ হতো। দুইপক্ষের লড়াই শেষে কোনো এক পক্ষ জয়লাভ করতো কিংবা যুদ্ধ বিরতি হতো। নিরীহ মানুষ খুব একটা বিপদে পড়তো না। বিজ্ঞানের নতুন নতুন মারণাস্ত্র যুদ্ধের প্রচলিত ধারণা পাল্টে দিয়েছে। শুধুমাত্র সুইচ টিপে শত্রু পক্ষকে শেষ করে দিতে তেমন সময় লাগে না। পুরো পৃথিবী ধ্বংস করার ক্ষেত্রে কিছু সংখ্যক মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়। বিজ্ঞান যেমন ভয়মুক্ত করতে একদিন বড় ভূমিকা পালন করেছে তেমনি আজ বিজ্ঞানই এখন ভয়ের সবচেয়ে বড় কারণ।

পৃথিবীর এমন একটা অবস্থায় আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষ ফেসবুক, পত্রপত্রিকা, গণমাধ্যমে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে নানা রকমের সংবাদ প্রচার করে মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। আবার কিছু সংখ্যক মানুষ ভয় পেয়ে নানা রকমের প্রতিক্রিয়া দেখায়। সবচেয়ে বড় প্রচার পায় বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মায়ের আকুতি, চোখের পানি, চিঠি, আক্ষেপ ইত্যাদি।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ জানে না দেশে কতটি বৃদ্ধাশ্রম আছে এবং সেগুলোতে কতজন বসবাস করে। বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে নানা প্রচার এবং অপপ্রচার মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে এমনিতেই মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে তার মধ্যে এসব প্রচারণা আরো বেশি মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। যারা আতঙ্ক ছড়িয়ে দেন তারা কি কোনো প্রবীণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন? এদের মধ্যে কেউ কেউ কোনো দিন বৃদ্ধাশ্রম পর্যন্ত দেখেনি। আমি গত দশ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রায় সবক’টি বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে এসেছি। সবগুলো বৃদ্ধাশ্রম, প্রবীণ নিবাসে বসবাসরত প্রবীণের সংখ্যা দুই হাজারের কম বলে আমার ধারণা।

সবচেয়ে বড় বয়স্ক পূনর্বাসন কেন্দ্র গাজীপুরে বসবাসকারী প্রবীণের সংখ্যা দুইশ’র নিচে। আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসে বসবাসকারী প্রবীণের সংখ্যা চল্লিশের কম।

অসুস্থ, অসহায়, স্মৃতিশক্তি হারানো এবং প্রতিবন্ধীদের রাখার দুটি প্রতিষ্ঠানে শতাধিক প্রবীণ বসবাস করে। থাকার লোকের অভাবে সরকারের বড় ৬টি প্রবীণ নিবাস বন্ধ করতে হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে চনপাড়ায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের নির্মিত পাঁচশ’ শয্যার বহুতল ভবনের ঘরগুলো ফাঁকা, কেউ থাকে না। বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে নানা রকমের গল্প, ঘটনা, রটনা কিছু মানুষের ভয় তৈরি করে দিচ্ছে। অনেকেই বৃদ্ধাশ্রমে সাহায্য সহযোগিতা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই ভয় বিক্রি করে কেউ কেউ নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার কিছু সংখ্যক মানুষ বৃদ্ধাশ্রম বানানোর জন্য নিজেরা উদ্যোগ নিয়েছে। আবার কেউ কেউ সাহায্য সহযোগিতার জন্য জনসাধারণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে। দেড় দুই হাজার প্রবীণ বৃদ্ধাশ্রমে, প্রবীণ নিবাসে বসবাস করে তাদের জন্য যে পরিমাণ আহাজারি শুনতে পাই তার শতভাগের একভাগ আহাজারি শুনতে পাই না হাসপাতালের বারান্দায় চিকিৎসার জন্য পড়ে থাকা অসহায় প্রবীণদের জন্য। ঢাকা শহরে একাকী বসবাসকারী প্রবীণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নিজের বাড়িতে, নিজের ফ্ল্যাটে একাকী প্রবীণ মৃত্যুবরণ করেন, খোঁজ-খবর নেবার লোকজন পাওয়া যায় না। এখন জেলা শহরগুলোতে একাকী প্রবীণের বসবাস নজরে আসছে। সারা দেশেই মূলত বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণ নিবাসে রূপ নিতে যাচ্ছে। ছেলে-মেয়েদের সাথে থাকার সুযোগ সব প্রবীণরা পাবেন না এবং এটা সম্ভব না। প্রবীণদের নানা রকমের শারীরিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পেশাদার সেবাকর্মী লাগবে। পরিবার পরিজনের কাছ থেকে সার্বক্ষণিক সেবা যত্ন পাওয়া খুবই কঠিন হবে। প্রবীণদের নানামুখী সংকট প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মোকাবিলা করার উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। ছেলে-মেয়ে যদি বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা যত্নে নিয়োজিত হয় তবে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে সংকট তৈরি হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ছেলে-মেয়ের চাকরি বাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য, সাংসারিক কাজকর্ম, বন্ধুবান্ধব, সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে সময় দিতে হয়। চলাচলে অক্ষম প্রবীণদের সার্বক্ষণিক সেবা যত্ন করা ছেলে মেয়েদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব একটা বিষয়। তখন দরকার হবে প্রশিক্ষিত সেবাকর্মীর। সেবাকর্মীর বেতন, প্রবীণের চিকিৎসা ওষুধপত্রের খরচ কে বহন করবে সেগুলো আগে থাকতেই ব্যবস্থা করে রাখতে হবে।

সংকট মোকাবিলা করার প্রস্তুতি আগে থেকে নেয়া থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সহজ হবে। বৃদ্ধাশ্রমের ভয় দেখানোর লোকজন যেমন আছে তেমনি ভয় পাবার লোকজনও আছে। প্রবীণ হবার আগেই প্রবীণ জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভয় থাকবে না। সন্তান পিতা-মাতার সেবাযত্ন, দেখাশোনা, ভরণ-পোষণে অবহেলা করার প্রতিকার হিসেবে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩ রক্ষাকবচ হিসেবে রয়েছে। কঠিন আইন থাকার পরও প্রবীণের দুঃখ দুর্দশা লাঘব হচ্ছে না। প্রবীণের খাবার, শোবার, চিকিৎসা, বিনোদনের ব্যবস্থা থাকলে ভয় কাটবে। প্রবীণরা জীবনকে উপভোগ করার জন্য উৎসাহী হবে।

বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা মূলত তরুণ প্রজন্মের বিরুদ্ধে মানুষের রাগ ক্ষোভকে উসকে দেয়া, ঘৃণার চাষবাস করে আন্তঃপ্রজন্ম সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করা জীবনকে বিষিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে আলোচনা হবে মূলত প্রবীণরা কীভাবে শান্তিতে স্বস্তিতে বসবাস করতে পারে সেই বিষয় নিয়ে। কি ধরনের উদ্যোগ ব্যবস্থাপনা থাকলে প্রবীণ নিবাস বৃদ্ধাশ্রমগুলো প্রবীণবান্ধব হবে তার রূপরেখা প্রণয়ন। সমাজ পরিবর্তন হলে সেটাকে আগের জায়গায় স্থাপন করা যায় না যেমন বার্ধক্যে এসে যৌবনে ফিরে আসা যায় না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত