ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ন্যাটো সম্মেলন : ইউরোপের নিরাপত্তা বনাম প্রতিরক্ষা ব্যয়

অলোক আচার্য
ন্যাটো সম্মেলন : ইউরোপের নিরাপত্তা বনাম প্রতিরক্ষা ব্যয়

এবারের সদ্য শেষ হওয়া ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের একটি আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। গুরুত্বের কারণ হলো বৈশ্বিক রাজনৈতিক এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি। মাত্র কয়েকদিন হলো যুদ্ধবিরতি হয়েছে- মধ্যপ্রাচ্যের দুই শক্তিধর দেশ ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যেকার সামরিক সংঘাত। তবে এখনও যে পুরোপুরি তার রেশ কেটেছে এমনটা নয়। এরপর কি ঘটবে সে নিয়েও রয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা।

অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বিশ্বে বেশি রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছে বলেই মনে করা হচ্ছে। যুুদ্ধ চলছে এবং যুদ্ধ যুদ্ধ মনোভাবও প্রকট হচ্ছে। এই সময় নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে এবং প্রতিপক্ষকে সতর্ক করতে ও কিছু সিদ্ধান্ত নিতে এ সম্মেলন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি আলোচনা। মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের অনিশ্চয়তার মধ্যেই নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়।

হোয়াইট হাউসে ফেরার পর এটিই ট্রাম্পের প্রথম ট্রান্সআটলান্টিক সফর। এবারের সফরে সামরিক ব্যয় ও ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে পূর্বনির্ধারিত কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

ন্যাটোর ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল সম্মেলন এটি ন্যাটোর নতুন প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা গোপন থাকলেও রুটে সম্প্রতি বলেন, রাশিয়া আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ন্যাটোর যে কোনো সদস্য দেশে আক্রমণ করতে পারে।

সে অনুযায়ী ন্যাটো ৪০০ শতাংশ বেশি আকাশ ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা, হাজার হাজার নতুন ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান আর কয়েক মিলিয়ন অতিরিক্ত কামানের গোলা চায়। এই প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে রাশিয়ার আশপাশের দেশগুলো প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে ৫ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। সেই ঘোষণাও এসেছে সম্মেলন শেষে। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো তাদের জিডিপির ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে সম্মত হয়েছে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। সম্মেলন শেষে জোটভুক্ত ৩২টি দেশ এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সদস্যরাষ্ট্রগুলো ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রতিবছর জিডিপির ৫ শতাংশ মূল প্রতিরক্ষা চাহিদা এবং প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট খাতে বিনিয়োগের অঙ্গীকার করছে। এ চুক্তিকে ‘সবার জন্য একটি মহান বিজয়’ বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জিডিপির ৫ শতাংশ দুই ভাগে ভাগ করা হবে। সাড়ে ৩ শতাংশ বরাদ্দ হবে মূল প্রতিরক্ষা খাতে। জোটে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ বিনিয়োগ করে।

এর অর্থ হলো- এখন ন্যাটোর দরকার আরও বেশি প্রতিরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত করা। আরও বেশি অর্থায়ন এবং প্রস্তুতি। একটি সামরিক জোট বনাম রাশিয়া। এখানেই স্পষ্ট যে, রাশিয়ার চোখ থেকে ন্যাটো জোটের সবচেয়ে শক্তিশালী ভরসার নাম যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ইউরোপ নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি নতুনভাবে ভাবতে শুরু করে, যখন যুক্তরাষ্ট্র আগের ভূমিকা থেকে সরে আসে।

সুতরাং নিজেদের রাশিয়া বা অন্য কোনো বড় দেশের সামরিক হুমকি থেকে রক্ষা করতে হলে যে সক্ষমতা দরকার সেটি অর্জন করাই ইউরোপের মূল উদ্দেশ্য। ন্যাটোতে বিনিয়োগ নিয়ে ট্রাম্পের বরাবরই অভিযোগ ছিল। আবার ন্যাটো ছেড়ে আসাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজ না।

ন্যাটো নিশ্চিতভাবেই এই মুহূর্তে বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী সামরিক জোট। এই জোট আরও প্রসারিত করার চেষ্টাই করছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো। এরমধ্যেই সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে।

ন্যাটো প্রসারিত হয়েছে। ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাখা ন্যাটোরও একটি কৌশল ছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা খুব বেশি সফল হয়নি। কারণ রাশিয়ার উপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সত্ত্বেও রাশিয়ার অর্থনীতি এখনও ভালো অবস্থানে এবং বৈশ্বিক ক্ষমতায়নে নিজেকে শক্তভাবে উপস্থাপন করেছে। ন্যাটো এবং রাশিয়া বিপরীত। তবে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না। কারণ প্রত্যক্ষভাবে ন্যাটোর যুদ্ধে জড়ানো অর্থ হলো- একটি ব্যাপকার যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। সেই ঝুঁকি এখনই নেবে না ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো। সেই আলোচনা-সমালোচনা এখনও চলছে। যুদ্ধে দুইভাবে হয়। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে। ইউক্রেন যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করছে ইউক্রেন এবং পরোক্ষাভাবে যুদ্ধ করছে তার মিত্রদেশগুলো। ইউক্রেন নিয়ে বাকি দেশগুলোর একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত বলে মনে হয়। কারণ ইউক্রেন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর সফলতা পাচ্ছে না। ইউক্রেনের বিশাল এলাকা রাশিয়ার দখলে রয়েছে। বিপুল অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং ইউক্রেনের অর্থনীতি এখন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সেখানে আরও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই এই যুদ্ধ একেবারে বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া। ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের ন্যাটো জোটে যোগ দেওয়ার প্রচেষ্টা করছে আগে থেকেই। উদ্দেশ্য মূলত ইউক্রেন যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সেরকম হলে এই সামরিক জোটের সহযোগিতা পাওয়া। কারণ ন্যাটো জোটভুক্ত কোনো দেশ আক্রান্ত হলেই তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। ফলে ন্যাটো জোটভুক্ত কোনো দেশকে সহজেই আক্রমণ করা সহজ কথা নয়। ইউক্রেন এখনও ন্যাটো জোটে যোগ দিতে পারেনি; কিন্তু ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার প্রচেষ্টা করছে যা রাশিয়ার ইচ্ছে নয়।

কিন্তু এই বিষয়টি রাশিয়ার মাথাব্যথার কারণ হবে। ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হবে এমন আশা করা হলেও সেটা হয়তো এই মুহূর্তেই হচ্ছে না। এটাও একটি কৌশলগত অবস্থান বলা যেতে পারে। কিয়েভকে ন্যাটো সহায়তা অব্যাহত রাখতেই পারে তবে পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা দিতে যুদ্ধ শেষের অপেক্ষা করতে হতে পারে। যদিও এই সিদ্ধান্ত কখন কোন দিকে মোড় নেয়, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না।

সেই ২০০৮ সালে জোটটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করা হবে। এখনও সেই কথাই বলা হচ্ছে। সেই সময় হয়তো আরও দীর্ঘায়িত হবে। এবারের সম্মেলনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘটছে।

ন্যাটো সম্মেলনের আগে একজন ইউরোপীয় কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, সম্মুখযুদ্ধে ইউক্রেন একটি ভঙ্গুর অবস্থায় আটকে পড়ায় একধরনের অস্বস্তির মধ্যেই এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাজেছ এবারের সম্মেলনে ন্যাটোকে একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী জোট হিসেবে দেখানোই উদ্দেশ্য। একদিকে যেমন ন্যাটোর বিস্তার বাড়ছে অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে স্নায়ুবিক প্রতিযোগিতাও বাড়ছে।

১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল ন্যাটো নামের এই সামরিক জোট প্রতিষ্ঠিত হয়। এর বর্তমান সদস্য দেশ ৩০টি। নতুন সদস্য হলো সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড। জোটটির প্রতিষ্ঠার সময় সদস্য ছিল ১২টি রাষ্ট্র এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জোটের সদস্য দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ন্যাটোর বিস্তৃতি ঘটছে। উল্লেখ্য ন্যাটোর সদস্যভুক্ত অধিকাংশই ইউরোপের দেশ (২৮টি)। বাকি দুইটি দেশ উত্তর আমেরিকার। এটি এমন একটি জোট যেখানে সদস্য দেশগুলিকে সম্মিলিতভাবে নিরাপত্তা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

ন্যাটো গঠিত হয়েছিল এমন একটি সময় যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। বর্তমানে স্নায়ু যুদ্ধের সেই মাত্রা না থাকলেও প্রতিযোগিতা রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সামষ্টিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অংশ হিসেবে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ন্যাটো সামরিক জোটের। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া। এরপর কিয়েভের পক্ষে দাঁড়ায় ন্যাটোর মিত্ররা। এর মাধ্যমে ন্যাটো মূলত জোটটির প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্যেই ফিরে গেছে।

ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেন যে, ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের কাছে একটা নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে ন্যাটো জোটকে পূর্ব দিকে আর সম্প্রসারণ করা হবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। সে সময় থেকে এ পর্যন্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা তার প্রভাব বলয়ের অংশ ছিল এমন অনেক পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশ ন্যাটোর সদস্য হয়েছে। ন্যাটো জোটের এই সম্প্রসারণ যা রাশিয়া মেনে নিতে পারছে না।

এই যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেনের মাটিতেই, যুদ্ধ করছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী কিন্তু অস্ত্র, অর্থ এবং অন্যান্য জিনিসের জোগান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো। যুদ্ধে কোনো ধরনের মীমাংসা হওয়ার আগ পর্যন্ত যে পশ্চিমা দেশ ও ন্যাটো থেকে সহায়তা পাবে ইউক্রেন সেটা ধারণা করা যায়। ন্যাটোর সদস্য না হলেও ইউক্রেনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবেই দেখছে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র।

মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর প্রক্সিযুদ্ধ মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যদিও এবারের ন্যাটো সম্মেলনের সবচেয়ে বড় অর্জন বলতে মিত্র দেশগুলোর ট্রাম্পের আহ্বান মেনে প্রতিরক্ষা ব্যয় ৫ শতাংশে উন্নীত করা। এখন যা আছে ২ শতাংশে এবং এখান থেকে ৫ এ উন্নীত করতে গেলে অনেক দেশেরই বেশ ঝামেলায় পরতে হবে। কারণ এ এক বিশাল ব্যয়। সম্ভবত ট্রাম্পকে খুশি রাখাটাই ইউরোপীয় নেতাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপুর্ণ ছিল। বহুদিন ধরেই ট্রাম্প এ নিয়ে কথা বলছিলেন। এখন সেটি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। সুতরাং এবারের ন্যাটো সম্মেলনের পর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর সম্পর্ক আরও মজবুত হলো বলেই ধরে নেওয়া যায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিষ্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত