হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) বহুমুখী ব্যাপক ও বিস্তৃত জ্ঞানের অধিকারী, গভীর বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, তীক্ষè মেধা, ঐশী-শক্তিসম্পন্ন, বিচক্ষণ বিশ্লেষক, মানবদরদী সমাজ কল্যাণকামী এই মহান পুরুষ তার পরিচ্ছন্ন, উদার ধর্ম ও সমাজ চিন্তার আলোকে সমগ্র মানব সমাজের উন্নয়ন ও আধ্যাত্মিক জীবন গঠনের মহান দায়িত্ব নিয়ে ১৯৩৫ সালে সাতক্ষীরা জেলার নলতা শরিফ নামক গ্রামে ‘নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন’ প্রতিষ্ঠিত করেন এবং ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন স্থানে এর শাখা মিশন প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। বর্তমান বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে শতাধিক শাখা মিশন মানবতার সেবায় নিয়োজিত। এদের মধ্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শাখা মিশন হলো- হবিগঞ্জ আহ্ছানিয়া মিশন, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, ঢাকা মেট্রোপলিটন আহ্ছানিয়া মিশন, খুলনা আহ্ছানিয়া মিশন, চব্বিশ পরগণা আহ্ছানিয়া মিশন, ইউএস আহ্ছানিয়া মিশন অব ভার্জেনিয়া। প্রত্যেক শাখা মিশনের মাধ্যমে মানুষের সুখ, দুঃখ, ব্যথা বেদনার উপশম করা হয়। আল্লাহ তায়ালার বন্দেগির ধারা বর্ণিত হয়।
মিশনের মূল লক্ষ্য স্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টির সেবা। এই মিশন সমগ্র মানব জাতির সামাজিক ও আধ্যাতিক উন্নতি সাধন করিবে। এই মিশন মানুষে মানুষে পার্থক্য (বিভেদ) দূর করবে, একতা ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করবে এবং স্বর্গীয় প্রেমের অনুপ্রেরণা যোগাবে। এই মিশন মানুষের নিজের (একের) অসারতা বুঝিতে ও গর্ব পরিহার করিতে শিক্ষা দিবে। এই মিশন মানবকে স্্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্ক চিহ্নিত ও অনুধাবন করিতে এবং স্্রষ্টা ও তাহার অনুসারীদের প্রতি কর্তব্য পালন করিতে সহযোগিতা করিবে এবং বৃহত্তর নিপীড়িত মানবতার প্রতি সম্ভাব্য সহযোগিতা/সাহায্য কারিতে শিক্ষা দিবে। আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন শহর থেকে দূরে সরিয়া মানবের খেদমত করায় আমি, জীবনের উদ্দেশ্য স্থির করিয়াছি।
খেদমতে যে আনন্দ, মখ্দুমিয়াতে তাহা নেই। আমিত্ব দূরীভূত না হইলে মহব্বতের প্রসার হয় না। সৃষ্টির প্রতি প্রেম না জন্মিলে স্্রষ্টার প্রতি পেম হয় ন। ভ্রাতৃত্ব বিস্তার ও তৎসহ শান্তির সৃষ্টি মদীয় জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এই মিশন বিগত আট দশক ধরে সামাজিক জীবন গঠন, নৈতিক চরিত্র গঠন, সমাজ উন্নয়ন, শিক্ষা প্রসার, জনসম্পদ উন্নয়ন ও আধ্যাত্মিক জীবন গঠনের জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন ঈদ-ই মিলাদুন্নবী, ফাতেহা ইয়াজ দহম, হযরত পীর কেবলা (র.) এর ওরস শরিফ, এতেকাফ শরিফসহ প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান যথাযথ মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যের সাথে উদযাপন করে থাকে। শিক্ষার প্রসার ও সমাজের খেদমতের জন্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, লাইব্রেরি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মিশনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। চক্ষু রোগীদের সেবার জন্য মিশন ১৯৮৬ সাল থেকে চক্ষু চিকিৎসা শিবির পরিচালনা করছে। রোগীর চোখের লেন্স লাগানোর জন্য খুলনাতে বিএনএসবি হাসপাতালে পাঠানো হয়। সব রোগীর লেন্স লাগানোর ব্যয়ভার কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন বহন করে। এরইমধ্যে নলতা শরিফে একটি স্থায়ী চক্ষু ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে। এখানে প্রতিদিন অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা চোখের চিকিৎসা দেয়া হয়। এছাড়া ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, খুলনা আহ্ছানিয়া মিশন, হবিগঞ্জ আহ্ছানিয়া মিশনসহ বিভিন্ন শাখা মিশনের মাধ্যমে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, লাইব্রেরি, মসজিদ, কারিগরি প্রশিক্ষণ, এতিমখানা ইত্যাদি অসংখ্য সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব শাখা মিশনের মধ্য ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের কার্যক্রম দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও সেনিটেশন, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, বৃক্ষরোপণ, গৃহসংস্থান, সকল প্রকার শিক্ষা পদ্ধতির উন্নয়ন ও বিস্তার, শিক্ষা উপকরণ উদ্ভাবন, শিক্ষা সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ, গ্রন্থ উন্নয়ন ও বন্টন এবং এতদ্সম্পর্কিত গবেষণা, জরিপ ও মূল্যায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, আইটি ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ভকেশনাল ট্রেনিং কেন্দ্র ইত্যাদি ঢাকা আহ্ছানিয়া প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করছে। এরইমধ্যে ঢাকা আহছানিয়া মিশনের উদ্যোগে ‘আহছানিয়া ক্যান্সার হাসপাতাল’ ‘আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সাফল্য, পুরস্কার লাভ ও পরিসমাপ্তি : হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) তার কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার স্বীকৃতি অল্প সময়ের মধ্যেই অর্জন করেন। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার কতৃক তাকে ‘খানবাহাদুর’ উপাধি প্রদান করা হয়। তিনি চাকরিতে প্রবেশের মাত্র ১৫ বৎসরের মধ্যে এই সাফল্য অর্জন করেন। ১৯১১ সালে তিনি সদস্য পদ লাভ করেন। তিনি ১৪ এপ্রিল-১৯১৯ তারিখে ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস ভুক্ত হন।
তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এক দশকেরও বেশি সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোঠের (বর্তমান সিনেট) মেম্বার ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি লগ্নে ড. নাথান সাহেবের অধীনে কমিটির মেম্বার ছিলেন। বাংলা সাহিত্য বিশিষ্ট ও বহুমুখী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি তাকে ১৯৬০ সালে সম্মানসূচক ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করেন। সমাজসেবা, সমাজ সাংস্কৃতিতে বিশেষ করে দীন প্রচারের কাজে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ পুরস্কারে ১৪০৪ হিঃ মরণোত্তর ভূষিত হন।
হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) পরলোক-গমনের পর মওলানা আকরাম খাঁ দৈনিক আজাদের (২৮শে মাঘ, ১৩৭১) যে সম্পাদকীয় নিবন্ধ রচনা করেন, তার অংশ বিশেষ নি¤েœ উদ্ধৃত হলো-‘এই আন্দোলন ইতিহাস কাহারো একক কর্মধারার বৃত্তে সীমাবদ্ধ নহে। বহুজনের কর্মে ও সাধনায়, ধ্যানে ও জ্ঞানে’ সাফল্য ও ব্যর্থতার যে আন্দোলন মুসলিম জাতির মূল জীবন প্রবাহের অঙ্গীভুত হইয়া পড়িয়াছে, তাহার পরিপূর্ণ ইতিহাস যেদিন লিখিত হইবে সেইদিন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা সাহেবের ভূমিকার যথাযথ গুরুত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব হইবে। দীর্ঘদিন তিনি বাঁচিয়া গিয়াছেন এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি ইসলাম ও মুসলিম সমাজের নীরব কর্ম সাধনায় আত্মনিয়োগ করিতে পারিয়াছিলেন, ইহা আল্লাহর কম মেহেরবাণী নহে। তাহার মৃত্যুতে সমাজের একটি দিক সম্পূর্ণরূপে শূন্য হইয়া গেল।
নীরব সাধনা ও সংগ্রামে, সমাজের সম্বিত ফিরিয়ে আনার জন্য সমাজের সার্বিক গতি সঞ্চারণের মানসে যে জীবনটি কেটেছে, সেই মহাপ্রাণ পুরুষ সুলতানুল আউলিয়া, কুতুবুল আকতাব, গউছে জামান, আরেফ বিল্লাহ, শাহ্ ছুফি আলহাজ হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) অগণিত মানুষকে শোক সাগরে ভাসিয়ে পর্দার অন্তরালে চলে যান প্রায় ৯২ বছর বয়সে ১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু রয়ে যায় তার রেখে যাওয়া আদর্শ, কর্মকাণ্ড। আদর্শই মানুষের পথ প্রদর্শক। হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) আমাদের সম্মুখে রেখে গেছেন শাশ্বত আদর্শ। যে আদর্শিক চিন্তা-চেতনা ও জীবন দর্শনকে বহন করে চলেছে তার গ্রন্থসমূহ যা অনুসরণ করে জীবনকে কৃতার্থ করেছে অগণীত মানুষ। তার এই আদর্শকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য রেখে গেছেন ‘আহ্ছানিয়া মিশন’ যার মাধ্যমে তার রুহানী সন্তানরা সে লালনে বদ্ধপরিকর।