একটি জাতির পরিচয় নির্ধারণের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো তার ভাষা। ভাষা একটি জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং আত্মপরিচয়ের প্রতিচ্ছবি। বাংলা ভাষা বাঙালির হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত, যার জন্য একদিন তরুণরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি সেই আত্মত্যাগের দিন, যে দিনটিকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাঙালি জাতি তাদের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগ্রাম করেছিল, সেটিই পরবর্তীকালে স্বাধীনতার পথে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়। ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার জন্য সংগ্রাম ছিল না, এটি ছিল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির এক অদম্য প্রত্যয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া উর্দু ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর যে ইতিহাস, তা পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত রচনা করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে, কেবল ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেই চলবে না, রাজনৈতিক মুক্তিই পারে একটি জাতিকে প্রকৃত স্বাধীনতা দিতে। তাই একুশের চেতনা শুধু ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের লড়াইয়ের প্রতীক।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও শুরু : ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল এক চরম অবিচার। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এই ঘোষণার পরপরই ঢাকাসহ সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এই ঘোষণার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে এবং বাংলা ভাষার দাবিতে সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলে।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকার রাজপথে প্রথম বড় আকারের ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে এবং মিছিল বের করে। পাকিস্তান সরকার আন্দোলন দমন করতে পুলিশের মাধ্যমে দমননীতি গ্রহণ করে এবং অনেক ছাত্র-জনতাকে গ্রেপ্তার করে। অনেক তরুণ নেতা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৫০ সালের পর থেকে আন্দোলন আরো ব্যাপক হতে থাকে। ঢাকার রাজপথে, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও অন্যান্য শহরে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ করতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তবুও বাংলা ভাষার দাবিকে উপেক্ষা করে। ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা দেন যে, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’
এই ঘোষণার বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের ক্ষোভ চরমে পৌঁছায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে তারা মিছিল করতে শুরু করে। বেলা গড়াতেই আন্দোলন দমন করতে পুলিশ গুলি চালায়। এতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে। এই আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে। তবে ততদিনে বাঙালি বুঝতে পেরেছিল, শুধু ভাষার অধিকার পেলেই চলবে না, তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্যও লড়াই করতে হবে। ভাষা আন্দোলন ছিল, সেই চেতনার প্রথম ভিত্তি, যা পরবর্তীকালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে দেয়। ভাষা আন্দোলন আমাদের চিনিয়ে দেয়, ভাষা শুধু কথোপকথনের মাধ্যম না এটি আমাদের অস্তিত্ব, আত্মপরিচয় এবং জাতিসত্তার প্রতীক। এই আন্দোলনই বাঙালিকে নিজের অধিকার আদায়ের শিক্ষা দেয়, যা একদিন আমাদের স্বাধীনতার দোরগোড়ায় নিয়ে আসে।
ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য ও জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ : ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রথম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে এটি ছিল প্রথম বড় আন্দোলন, যা বাঙালির রাজনৈতিক স্বাধীনতার পথ তৈরি করে দেয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার গুরুত্ব অস্বীকার করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা মূলত বাঙালিদের দমিয়ে রাখার কৌশল ছিল। কারণ, ভাষার ওপর আধিপত্য কায়েম করা মানেই সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বাঙালিরা কখনোই নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন মেনে নেয়নি। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে শুরু করে। ভাষা আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বাঙালির রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ।
১৯৫২ সালে এই আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হয় যে, কেবল সাংস্কৃতিক অধিকারের লড়াই নয়, তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও সংগঠিত হতে হবে। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী বছরগুলোতে আমরা দেখতে পাই, রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোতে ছাত্রসমাজ ও জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ বেড়ে যায়। ভাষা আন্দোলনই মূলত পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার বৈষম্যেও বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ভিত্তি তৈরি করে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও মধ্য দিয়ে সেই প্রতিরোধ চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। ভাষার প্রশ্নে যে চেতনার উন্মেষ হয়েছিল, তা-ই একসময় আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রধান প্রেরণা হয়ে ওঠে।
ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে : ভাষা আন্দোলন শুধু সাংস্কৃতিক বা ভাষাগত অধিকার আদায়ের লড়াই ছিল না, এটি ছিল বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ। ১৯৫২ সালে যখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তরুণরা প্রাণ দিলেন, তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে বাঙালির স্বার্থের বিরোধ আছে। ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও সুসংহত হতে থাকে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জনগণ ভোটের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেয় যে, তারা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় দমননীতি মানবে না। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল দল জয়ী হয় এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। যদিও পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার নানা ষড়যন্ত্র করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বিলুপ্ত করে দেয়। তবুও এটি ছিল বাঙালির রাজনৈতিক চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা ছিল মূলত বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে একটি সুস্পষ্ট আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক সচেতনতার সূচনা হয়েছিল, ছয় দফা ছিল তারই পরবর্তী ধাপ। এই ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি সুস্পষ্টভাবে উঠে আসে। এরপর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা চালায়। এর পরপরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, যা ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি। ভাষা আন্দোলনের সময় যে চেতনার জন্ম হয়েছিল, সেই চেতনাই একদিন আমাদেও মুক্তিযুদ্ধেও অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালে রাজপথে যারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে বীজ রোপিত হয়েছিল, সেটিই ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে পূর্ণতা পায়।