১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, সামাজিকমাধমে বিচরণ করতে করতে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো এমন একটি শিরোনামের দিকে। ২০২১ সালে তুরাগপাড়ের বোট ক্লাবে সংগঠিত ঘটনার মামলায় গেলো ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ পরীমনি জামিন লাভের পর সাংবাদিকদের উদ্দেশে এমন কথা বলেন। খবরটি পাঠ করে আমরা ফিরে যাই সাড়ে ৩ বছর আগের ঘটনায় যে দিন
পরীমনি গভীর রাতে বোট ক্লাবে গিয়ে মাতাল অবস্থায় ভাঙচুর ও মারামারিতে লিপ্ত হন। আসলে এধরনের ‘সোশ্যাল ক্লাব’, ‘ডিজে ক্লাব’ কিংবা ‘বার’ কালচারে অভ্যস্থ পরীমনির মতো আমাদের সমাজের একটি অংশ। এসব ক্লাব ও বারকে কেন্দ্র করে যাপিত হচ্ছে তাদের প্রাত্যহিক জীবনাচার। বার্থ ডে, গায়ে হলুদ, গেট টুগেদার ইত্যাদি যেকোনো ঠুনকো প্রয়োজনে ক্লাবের সদস্যরা এখানে পার্টিতে মিলিত হন। রাত ভোর চলে তাদের এই আয়োজন। ‘হার্ড ড্রিঙ্কস’ ও ‘ডিনার’র সাথে চলে তাদের পার্টি উদযাপন। কেউ কেউ আবার মেতে ওঠেন উদ্যাম নাচে আর লাগামহীন মাস্তি ও ফূর্তিতে। এমন জীবনযাপন আমাদের সার্বিক আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে আদৌ কি কোনো যৌক্তকতার দাবি রাখে? ‘ক্লাব’ বলতে আমরা অনেকেই হয়তো স্পোর্টস ক্লাবগুলোকে মনে করতে পারি, তবে স্পোর্টস ক্লাব নিয়ে এখানে বলা হচ্ছে না। ‘ঢাকা ক্লাব’ বা ‘বোট ক্লাব’ টাইপের কিছু সামাজিক ক্লাব আজকের আলোচ্য বিষয়।
এধরনের ক্লাবগুলো সাধারণত লিমিটেড কোম্পানির সনদ নিয়ে পরিচালিত হতে দেখা যায়। এদের একটি কমিটি থাকে, যারা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ক্লাবগুলো পরিচালনা করে থাকেন। ‘ঢাকা ক্লাব লিমিটেড’ হলো এই আলোচিত ক্লাবগুলোর পূর্বসূরী বা ‘আদি পিতা’। ঢাকা ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫১ সালে। উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয়দের বিনোদনের জন্য ঢাকার রমনায় চালু করা হয় ঢাকা ক্লাব। তখন শুধু শ্বেত চামড়ার ব্যক্তিরাই ক্লাবে যাতায়াত করতেন। ঢাকা ক্লাব কাগজে কলমে নিবন্ধিত হয় ১৯১১ সালের ১৯ আগস্ট। এটি বাংলাদেশে অবস্থিত হলেও এই ক্লাবের দাপ্তরিক ভাষা কিন্তু ইংরেজি। ক্লাবটির সাথে দেশের সাধারণ মানুষের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এমনকি দেশের কোনো কল্যাণে এই ক্লাবের কোন ভূমিকা দেখা যায় না। এই ক্লাবের সদস্য সংখ্যা সাড়ে চার-পাঁচ হাজার হলেও এর স্থায়ী সদস্য দেড় হাজার। দেশের কৃষ্টি কালচারের সঙ্গে ঢাকা ক্লাবের নিয়মকানুন সাংঘর্ষিক হলেও এই ক্লাবের সদস্য হতে পারলে সদস্যরা তাদের নিজেদের গর্বিত মনে করেন। এমন গর্বিত হবার কারণই বা কি?
১৯০ বছর ব্রিটিশ বেনিয়া দ্বারা শাষিত বাংলার কিছু মানুষ মনের অজান্তেই হয়তো ব্রিটিশ বনে গেছেন। তা না হলে তারা এধরনের ক্লাবের সদস্য হতে পারলে কেনইবা নিজেকে ধন্য মনে করবেন। বিশ্বের সিংহভাগ অঞ্চল শাসন করার জন্য ব্রিটিশরা নিজেদের যেমন ‘এলিট’ মনে করেন ঠিক, তেমনি এসব সোশ্যাল ক্লাবের সদস্যরাও নিজেদের ‘এলিট প্রাণী’ ভাবেন। ক্লাবের কোনো কোনো সদস্য প্রতি মাসে পাগলা পানীয় পানের জন্য লাখ টাকার বিল পরিশোধ করে থাকেন। এটিও হয়তো তাদের অহংবোধের কারণ হতে পারে। অনেক সাধারণ নাগরিকের কৌতূহল থাকে এই ধরনের ‘অভিজাত’ ক্লাবকে ঘিরে। কি আছে এখানে? জানা যায়, বার ও রেস্টুরেন্ট ছাড়াও ঢাকা ক্লাব প্রাঙ্গণে রয়েছে অনেকগুলো অতিথিশালা। আরো আছে বিলাসবহুল প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট। সুইমিংপুল, জিমনেশিয়াম, বিলিয়ার্ড বোর্ড, স্কোয়াশ, টেনিস কোর্টসহ আছে বিশেষ আয়োজন। ঢাকা ক্লাবে প্রবেশ করতে হলে তাদের নির্ধারিত ‘ড্রেস কোড’ অনুসরণ করতে হয়। স্বনামধন্য লেখক ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার একবার ঢাকা ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েও এই ক্লাবে প্রবেশ করতে পারেননি।
এ ছাড়া অনেক বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ঢাকা ক্লাবে প্রবেশ করতে যেয়ে এমন হেনস্তার শিকার হয়েছেন তা অনেকেরই জানা। এই ক্লাবে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নেই। নেই কোনো সমাজ সেবামূলক কার্যক্রম। এটি যেন এক ভিন্ন জগৎ। কথিত আছে এর সদস্য হতে হলে দরকার অর্ধকোটি টাকা। তাও আবার এর সদস্য সংখ্যা সীমিত। তাই অর্থবল থাকলেও অনেকেই এর সদস্য হতে পারেন না। তাতে কি? আগ্রহীরা এই ক্লাবের আদলে গড়ে তুলেছেন আরো কিছু ক্লাব। গুলশান, ধানমন্ডি, বনানী’র মতো অভিজাত এলাকার পাশাপাশি উত্তরা, পূর্বাচল এমনকি মিরপুরের মতো এলাকাতেও গড়ে ওঠেছে এধরনের ক্লাব সংস্কৃতি। হাল আমলের বহুল বিতর্কিত ‘ঢাকা বোট ক্লাব’র একটি ঘটনায় দেশবাসী এই ক্লাব কালচার সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পেয়েছেন। যা লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকার বাইরেও দেখা যায় এ ধরনের ক্লাবের অস্তিত্ব। চট্টগ্রামে ও নারায়ণগঞ্জে গড়ে ওঠেছে এ ধরনের ক্লাবের রেপ্লিকা। ক্লাব কালচারের স্বরূপ কি? বাস্তবে এখানে কি হয়? কারা এখানে যাতায়ত করেন? কারাইবা এই ক্লাবগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন? এসব প্রশ্নের অনেক উত্তর দেশের নাগরিকরা জানতে পারেন ২০২১ সালে ঢাকা বোট ক্লাবে সংগঠিত বহুল আলোচিত একটি ঘটনার মাধ্যমে। চলচিত্র নায়িকা পরীমনি সে বছর জুন মাসে এক রাতে বোট ক্লাবে যান। সেখানে মদ্যপান করে মাতাল হয়ে এক লঙ্কাকাণ্ড ঘটান। সে ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে রাজধানীর উত্তরে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন তুরাগ নদীর তীরে গড়ে ওঠে ‘ঢাকা বোট ক্লাব’ নামক এই ক্লাবটি। জানা যায়, বোট ক্লাবের দোতলায় রয়েছে বার ও রেস্টুরেন্ট। তৃতীয় তলায় রয়েছে গেস্ট রুম। যেখানে অনৈতিক মেলামেশার অভিযোগ পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অন্যের জমি দখল করে অবৈধভাবে গড়ে ওঠেছে এই বোট ক্লাব। তাই তখন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট করা হয় পুলিশের তৎকালীন আইজি বিতর্কিত ও দাম্ভিক ব্যক্তিত্ব বেনজীর আহমেদকে। সমাজের উচ্চবিলাসী, নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত একটি ধারা এ ধরনের ক্লাব কালচারের অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। নব্য অর্থশালী একটি গোষ্ঠী বিজাতীয় ক্লাব সংস্কৃতির প্রতি লালায়িত। এসব ক্লাবের সদস্যরা তৈরি করেছে তাদের নিজস্ব একটি বলয়। বিনোদন ও সুখ লাভের প্রত্যাশায় তারা এ ধরনের সার্কেল তৈরি করেন। এই সার্কেলে যুক্ত হয়ে তারা কতটা সুখী?
তাদের পরিবারের দিকে তাকালে তা অনেক খানি উপলব্ধি করা যায়। ধনাঢ্য হয়েও ‘প্রকৃত সুখ ও শান্তি থেকে তারা চিরকালই বঞ্চিত’, এমন আক্ষেপ তাদের মুখেই শোনা যায়। মদ্যপান ছাড়াও ক্লাবগুলোতে চলে ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর। চলে অবৈধ লেনদেনও। বড় বড় টেন্ডার ও কন্টাক্ট এখানে সুরাহা হয়। ফয়সালা হয় ঘুষ ও কমিশনের। ঘুষ ও অবৈধ কমিশন পার্সেন্টেজকে বৈধতা দিতে এসব ক্লাবের চতুর উদ্যোক্তরা প্রশাসনের উচ্চ পদের ব্যক্তিদের ক্লাবের সদস্যপদ উপহার হিসাবে প্রদান করেন বলে শোনা যায়। আসলে ‘এলিট সোসাইটি’ খ্যাত একটি গোষ্ঠী তাদের প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে এ ধরনের ক্লাব সৃষ্টি করে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ ব্যতীত অন্য কোনো সুচিন্তা ওনাদের মস্তিস্কে জাগ্রতা হয় না। প্রায় ২০০ বছর শাসন-শোষণ করা ব্রিটিশ বেনিয়ারা তাদের আভিজাত্য বজায় রাখতে ঢাকা ক্লাবের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছিল ক্লাব কালচার। যাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল এই উপমহাদেশের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্রিটিশরা এই অঞ্চল থেকে বিদায় নিয়েছে আজ (২০২৫ সাল) থেকে ৭৮ বছর আগে। অথচ এদেশের ক্ষয়িষ্ণু একটি ধারা আজও তাদের আচার আচরণ ও সংস্কৃতি আঁকড়ে আছে। যারা সৃষ্টি করছে দেশের ভেতর আরেক দেশ। এক দেশে তারা দুই আইন চালাচ্ছে। বিতাড়িত ব্রিটিশদের জীবনাচার আর আমাদের দেশের মানুষের জীবনাচার এক হতে পারে না। একে লালন করা মানে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা। সাথে সাথে আমাদের দেশকে বিজাতীয় সংস্কৃতির মাঝে সমর্পণ করা। নিরেট বাস্তবতা হলো দেশের কোন দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে এ ধরনের ক্লাবগুলো কখনো এগিয়ে আসেনি। দেশের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের দারিদ্রতা দূর করতে এই সোশ্যাল ক্লাবগুলোর ন্যূনতম ভূমিকা দেখা যায় না। ৫ আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে সময় এসেছে এই বিপথগামী বিজাতীয় ধারার কবল থেকে দেশ ও দেশের জনগণকে মুক্ত করার। এদের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে বয়কট করার। তবেই লাগাম টেনে ধরা যাবে অবৈধ লেনদেন ও ঘুষ দুর্নীতির। সমৃদ্ধ হবে আমাদের দেশ, দেশীয় অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশে ভাষার মাসে এমন প্রত্যাশা আমণ্ডজনতার।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, শেরেবাংলা নগর সরকারি
বালক উচ্চ বিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশন, ঢাকা।