ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দানব তৈরির সূত্র : অনুশোচনার অনুপস্থিতি!

রাজু আহমেদ
দানব তৈরির সূত্র : অনুশোচনার অনুপস্থিতি!

অনুতপ্ত হওয়া মানুষের গুণ। ভুল হতেই পারে। কিন্তু অপরাধের জন্য অনুশোচনা না থাকা, সংঘটিত অপরাধের চেয়েও বড় অন্যায়। কেউ যখন ভুল করেও সেটা প্রতিষ্ঠা করতে চায় তখন তার মধ্যকার মানবীয় গুণাগুণ লোপ পায়। ভুল করা এবং ক্ষমা পাওয়া- মানুষের চারিত্রিক ও নৈতিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু অন্যায় করেও অপরাধবোধ অনুভব না করা, অপরাধ করেও নির্লজ্জভাবে ‘আমি কী করেছি?’ প্রশ্ন তোলা কিংবা ক্ষতি করেও তা স্বীকার না করার দোষ- ভবিষ্যতে আরো বড় অপরাধ সংগঠনের আলামত উসকে দেয়। অনুতপ্ত না হওয়ার ব্যাধি ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়- সর্বত্র আছে। তখন মানুষ যদি ভুল স্বীকার করে তবে এমন কোনো অপরাধ নাই যার ক্ষমা পাওয়া যায় না। প্রত্যেক অপরাধের ক্ষমা হয়তো মানুষের কাছেও আছে, স্রষ্টার কাছেও। তবে কতিপয় অপরাধ যার সাথে কোনো মানুষের অধিকার তথা হক জড়িত সে সবের ক্ষমা যতক্ষণ বান্দাহ না করবেন ততক্ষণ প্রভুও করবেন না। কাউকে কষ্ট দেয়া, কাউকে ঠকানো কিংবা কারো কাছে ঋণ থাকাণ্ড এসবের ক্ষমা ভুক্তভোগী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকেই পেতে হবে। অপরাধ করে এবং অন্যায় হয়েছে জেনেও যাদের মাঝে অনুশোচনা বোধ জাগ্রত হয় না তারা দানব। এরা যে কোনো অন্যায় অনায়াসে করতে পারে। যারা অনুতপ্ত হয়, ক্ষমা চায় তাদের ক্ষমা করা মাহাত্ম্যপূর্ণ গুণ কিন্তু যারা অন্যায় করেও তা জায়েজ করার জন্য যুক্তি দেয়, তাদের ক্ষমা করলে আরো বড় বড় ক্ষতির মধ্যে পতিত হতে হবে। মানবীয় গুণাবলির মধ্যে ক্ষমা মহোত্তম এবং সর্বোত্তম। তবে যিনি ক্ষতিগ্রস্ত কেবল তার কাছ থেকেই ক্ষমা পেতে হবে। অপরাধ করে যারা অপরাধবোধে ভোগে তাদের মাফ না করলে মানবিকতা ক্ষুণ্ণ হয়। অপরাধ করেও যাদের মধ্যে অন্যায়বোধ জাগে না, নত হওয়া প্রয়োজন মনে করে না কিংবা নমনীয়তায় কথা বলে না- তারা সমাজ-সংসারের সম্যক অশান্তির কারণ। এদের সংস্পর্শে থাকলে অন্যরাও শান্তি পায় না। নিজেকে বিচার করার, কাজ মূল্যায়ন করার মানদ- যার কাছে নেই সে পশুর চেয়েও অধম হয়ে উঠতে পারে। কথা ও কাজের ক্ষেত্রে যার বিবেক-বুদ্ধি কাজ করে না সে এমন কোনো জঘন্য কর্ম নাই যা সংঘটিত করতে পারে না। মানুষ যখন দানব হয়ে ওঠে তখন প্রকৃত দানবের দানবীয়তাকে ছাড়িয়ে যায়। যারা ক্ষমা চায় না, ভুল স্বীকার করে না কিংবা অনুশোচনার মানসিকতা যাদের মধ্যে অনুপস্থিত তাদের ক্ষুদ্র অপরাধেরও শাস্তি বিধান না করে ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। পার পেতে পেতে যারা দানব হয়ে উঠতে পারে, ঘটাতে পারে নৃশংস বর্বরতা তাদের শুরুতেই রুখে দেয়া উচিত। সামান্য ভুল করার পরেও যারা ‘সরি’ বলতে কৃপণতা করে তারাই বড় বড় অপরাধে জড়িয়েও হেসে উড়িয়ে দিতে পারে। যে ক্ষমা চায় তার জন্য ক্ষমা অবারিত করতে হবে কিন্তু সাংঘাতিক রকমের অন্যায়-অপরাধ করেও যারা তাদের অবস্থানে অনড় থাকে তাদের ক্ষমা করার প্রশ্নই আসে না। এই ধরনের অপরাধগুলোর ক্ষমা করা মানে অপরাধীর কর্মকাণ্ডের আরো ব্যাপৃত পরিসরের পুনরাবৃত্তি হওয়া। যে ক্ষমা মহোত্তম, তা যদি অপরাধ স্বীকার ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেলে, তবে সেটাই আরো ভয়ংকর অপরাধের জন্ম দেয়। নিশ্চয়ই মানুষমাত্রই ভুল করবে। সেটা সামান্যের জন্যও হতে পারে আবার নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা কিংবা ক্ষমতায় থাকার জন্যও ঘটতে পারে। তবে তালাশ করে দেখতে হবে, নতুনভাবে ক্ষমা চাওয়া বা অনুতপ্ত হওয়া ব্যক্তির অতীতেও ক্ষমা প্রার্থনার নজির আছে কি না। এবং সে একই ভুল বারবার করছে কি না। ক্ষমা নিঃসন্দেহে সুন্দর। কিন্তু কেউ যদি অভিনয়ে ক্ষমা চায় এবং একই ভুল দ্বিতীয়বার সংঘটিত করে তবে তাকে শাস্তি ছাড়া ক্ষমা করা মানে আরো বড় পরিসরে অপরাধকে ব্যাপৃত করার সুযোগ করে দেয়া। ব্যক্তি পর্যায়ে এটা বিশ্বাসঘাতকতার সূচনা করে, সামাজিক পর্যায়ে এটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এটা ক্ষমতাধরদের দ্বারা ম্যাসাকারকে উৎসাহিত করে। অনুতপ্ত হওয়ার মানসিকতা সবার মধ্যে থাকুক। রাষ্ট্রীয় বিচার আলাদা বিষয়। বিচার হোক বা না হোক, চিন্তা-চেতনায় মানুষ হলে তার মধ্যে আত্মকৈফিয়ত জাগ্রত থাকা উচিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত