আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি ‘আল-মাহমুদ।’ ‘সোনালি কাবিন’ খ্যাত কবি ১১ জুলাই ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৯ সালে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে ঢাকায় ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। কবির ইচ্ছা ছিল, শুক্রবারে কোনো এক সময় যেন মৃত্যুর ডাক আসে। ‘স্মৃতির মেঘলাভোরে’ কবিতায় কবি বলেছিলেন- ‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে/মৃত্যুর ফেরেশতা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ/অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে/ ভালো-মন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’ তাই তো মহান আল্লাহ তার আরজি কবুল করেছেন, মৃত্যুর ফেরেশতা শুক্রবারেই তাকে নিয়েছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় ধরে সাহিত্য অঙ্গনে আল মাহমুদকে নিয়ে এক ধরনের ঘৃণার চর্চা হচ্ছে। তা হলো- আল মাহমুদ ধর্মান্ধ, জামায়াত শুভাকাক্সক্ষী। এসব বলে তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে সেকুলার পাড়ায় যতখানি আলোচনা সমালোচনা হয় সেটার বিপরীতে বিন্দু পরিমাণ সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা হয় না। বাংলা সাহিত্য আল মাহমুদের অবদান অবর্ণনীয়। তিনি একজন কিশোর কবিতার দক্ষ কারিগর। শৈল্পিক সত্ত্বার পরিপূর্ণ আধুনিক কবিতার দূরন্ত সূর্য। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবিন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা শুরু করেন এবং একের পর এক সাফল্য লাভ করেন।
আল মাহমুদ কবিতার শব্দ ব্যবহারে জীবনবোধে, শব্দালংকারের নান্দনিকতায় বর্ণনায় অসামান্য আর ধ্রুপদী, স্বতরবেদ্য স্বাভাবিকতা বিশ্বাসের অনুকূলতা নির্মাণে তিনি নিঃশংসয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় একজন অগ্রগামী কবি।
তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন আলোকিত চেতনার আবেগ। তার সেই চেতনাকে মুর্ত করেছেন। তার বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি প্রকাশ পেয়েছে দৃঢ়তা আর জীবনের গন্তব্যে। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের দলে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সোনালি কাবিন কাব্যগ্রন্থটি মাস্টারপিস হিসাবে সমাদৃত হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ হয়েছে অনেকগুলো ভাষায়, অনেকে কবিকে সহজে মানতে পারেনি, অনেক বিতর্ক প্রশ্ন সৃষ্টি করেন। তাতে কবির দুঃখ নেই। কবি বলতেন মানুষকে ভালোবাসতে হলে মানুষের কাছে আসতে হয়। প্রকৃতিকে ভালবাসতে হলে প্রকৃতির কাছে যেতে হয়।
মানুষের চেয়ে মহৎ যোদ্ধা আর কেউ নেই। জীবনটা বড়ই কঠিন। তিনি নিভৃতে সাহিত্য চর্চা চালিয়ে গেছেন। সমাজে তার চাহিদা চমৎকৃত। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। পরিপূর্ণ স্বার্থক মহৎ মানুষ।
তবে বলতে হয় কবি যতটা সম্মানের প্রাপ্য তা আমরা তাকে দিতে পারিনি। তার প্রাপ্য সম্মানটুকু যে তিনি পাননি; তা কবিরও ধারণা ছিল একরকম। তার প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘সাহসের সমাচার’ গ্রন্থে তিনি এ কথাটিই বলেছেন এভাবে-
‘তোমরা আমাকে বোঝোনি। আমি বলি না বুঝবে না, বুঝবে। তবে তখন আমি আর থাকব না। তবে এটা মনে রেখো, বাংলা সাহিত্যে যারা কিছু করতে চাও, আমাকে তোমার পাঠ করতেই হবে। এটা আমার আত্মবিশ্বাস।’
একবার এক সাক্ষাৎকারে কবি অভিমানের সুরে বলেছিলেন, ‘আমার কাঁধে বিরাট সংসার। আমার রোজগার দিয়ে ছেলে-মেয়েদের বড় করতে হয়েছে। ভালো কোনো চাকরি আমাকে কেউ দেয়নি। প্রচুর শ্রম দিতে হয়েছে। নানা ধরনের গদ্য লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করতে পারলাম না। বন্ধুদের, কবিদের দেয়া মানসিক চাপ উপেক্ষা করে সমাজে জায়গা করে নিতে হয়েছে আমাকে। কেউ কোনো স্পেস আমাকে দিতে চায়নি। অনেক ধাক্কা খেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, জেলও খেটেছি।
তারপরও কোনো আফসোস নেই। আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখে গেছেন, তার জন্য তাকে একটিমাত্র লেখায় বর্ণনা করা একেবারেই অসম্ভব। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের জাতীয় আত্মপরিচয় গড়ে তোলার একেবারে নেপথ্যে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে আল মাহমুদ একজন। আর বায়ান্নর ভাষাশহীদদের স্মরণে তার লেখা বিখ্যাত কবিতার মতো কবিতা দ্বিতীয় কেউ লিখতে পারেনি এবং ভবিষ্যতে পারবে কি না তা হয়তো ভবিষ্যতই বলে দেবে!! তিনি দুঃখি মানুষের অন্তর্দাহ ও দুঃখের অনুভূতিকে শিল্প নৈপুণ্যের সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছেন। এখানে কবির স্বার্থকতা। পাখির কাছে ফুলের কাছে (১৯৮০), একটি পাখি লেজ ঝোলা (২০০০) গ্রন্থ দুটি আমাদের শিশুসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ, (২০০৩) সালে প্রকাশিত হয় তার ছড়া সমগ্র।
কবি আল মাহমুদকে বাঁচিয়ে রাখবেন সোনালি কাবিন। দীর্ঘ জীবনে কবি কী পেলেন আর কী হারালেন? শেষ করি তার কবিতা থেকে। পাখির কাছে ফুলের কাছে কবি আল মাহমুদের একটি অবিস্মরণীয় কবিতা।
নারকেলের ওই লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল/ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল,/যেখানে চট্টগ্রাম শহর, পাথরঘাটার গির্জা লালদিঘি পাড়, পরির পাহাড়, দরগাতলা জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় মনের কোণে। আবেগ উচ্ছ্বাস সব একাকার হয়ে গেছে। তেমনি উপমা চিত্রকল্পে অসাধারণ চমৎকারিত্ব। কবি ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি লিখেছেন ভাষা আন্দোলনে কিছু ছড়া ও কিশোর কবিতা। ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/দুপুর বেলার অক্ত/ বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?/বরকতের রক্ত।/হাজার যুগের সূর্য তাপে জ্বলবে এমন লাল যে/সেই লোহিতের লাল হয়েছে/কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে। কবিতাটিতে আবেগময় ভাষায় অপূর্ব বাংলার গন আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরেছেন বাঙালির মূল গন্তব্য। তিনি যখন রাতদুপুরে কবিতায় বলেন : সবাই ঘুমিয়ে গেলে রাতদুপুরে/ চুপিসারে চলে এসো খোলা জানালা/নিশীথের নিরালায় নীল মুকুরে/ দেখো দেখো ভেসে যায় সোনার থালা।/তখন অপরূপ একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে, নীল আকাশ কেবল জেগে আছে, চারিদিকে নীরবতা। ওই আকাশে চাঁদটা ভেসে যাচ্ছে, কি চমৎকার।
সোনার বাসন কে যে আঁকে তিতাসে/ঢেউয়ে ঢেউয়ে ছলকায় রূপোর টাকা/লোক নেই, জন নেই, পানির পাশে/গাছগুলো মনে হবে দুঃখমাখা। একটা ঝিমধরা পরিবেশ উঠে এসেছে উপমায়। আকাশের চাঁদের ছবি এসে পড়েছে তিতাস নদীতে। সেই ছবি ঢেউয়ের মধ্যে রূপার টাকার মতো চকচক করছে। কোথাও কোনো মানুষ নেই। নীরবতা চারিদিকে নদীর গাছগুলো এমনভাবে ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে আছে যেন মনে হবে দুঃখমাখা। নিখুঁতভাবে লিখেছেন কবি উপমা। নান্দনিকতা ফুটে উঠছে। কবিতাগুলো যতই পড়ছি মুগ্ধতা ছুঁয়ে যায়।
তিনি অবিচল সাহসী প্রকৃতি প্রেমিক। তিনি চিরসবুজ সোনালি ঢেউ স্বপ্নঝরা অফুরন্ত প্রাপ্তি, কিশোর মনের ছেঁড়া ঘুড়ি, শান্ত তিতাস, কখনো নিরব বাতাস, শিশির ঝরারাতি, রাতদুপুরে খোলা জানালা, পাখির কাছে ফুলের কাছে আবেগ মাখা কিশোর মনের চাওয়া-পাওয়া, তিনি বাংলা সাহিত্যের গৌরব।
তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন আলোকিত চেতনার আবেগ। কবির হৃদয় সর্বদা সুন্দরের পূজারি। কিশোর কবিতাগুলোতে আমরা পাই স্নিগ্ধতা সবুজে ভরা স্বপ্নের বাংলাদেশ। অপরূপ রূপকথার মতো স্বপ্নময় প্রাণ ছোঁয়া কিশোর কবিতার জন্য তিনি উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন বাংলা কিশোর সাহিত্যে। ১৯৬৮ সালে লোক লোকান্তর ও কালের কলস নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম সোনালি কাবিন। কবি আল মাহমুদ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। তার রচনাগুণেই তিনি অনন্য বাংলা সাহিত্যের কিশোর কবিতার রাজকুমার হয়ে পাঠক প্রেমিদের মাঝে আজীবন হৃদয়ের পাতায় থাকবেন। মৃত্যুদিবসে তার কীর্তিকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।