ঢাকা সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গণমাধ্যমের গতিপথ

রনি রেজা
গণমাধ্যমের গতিপথ

যুগ থেকে যুগান্তর চলছে পরিবর্তনের মহড়া। চারিদিকে ঘটছে হু হু পরিবর্তন। দুর্বার গতিতে ছুটে চলছে সময়। সময়ের তালে ছুটছি আমরাও। গতিময় বিশ্বে এখন সহজলভ্য সব কিছুই। এসবের পেছনে রয়েছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আজ মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় তথ্যভাণ্ডার। বাতাসে ভাসে সব খবরাখবর। এ কারণেই চীনে হস্তলিখিত অবস্থায় শুরু হওয়া গণমাধ্যম আজ সব সীমানা অতিক্রম করতে পেরেছে। চীনের পরে আধুনিক সংবাদপত্রের জন্ম, মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার হয় ইউরোপে। ঊনিশ শতকে সংবাদপত্র হয়ে ওঠে ইউরোপ-আমেরিকার গণজাগরণের হাতিয়ার। একই সঙ্গে তা ছিল বিভিন্ন ভাবাদর্শ ও রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার বাহন। এক সময় সংবাদপত্রই ছিল গণযোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। পরিধি বেড়ে এখন তা রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট হয়ে সর্বস্তরে থাকা মুঠোফোন পর্যন্ত পৌঁছেছে। টুইটার, ফেসবুক, ব্লগ, ইউটিউব, মেসেঞ্জার, ভাইবার, স্কাইফি এবং ই-মেইল মানুষে মানুষে যোগাযোগকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে। ছোট্ট একটি সেলফোন হয়ে উঠেছে সামাজিক গণযোগাযোগের মাধ্যম। এখন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা বা গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। সংখ্যায়ও বেড়েছে।

বর্তমানে দেশে দুই ডজনের বেশি স্যাটেলাইট টেলিভিশন, বেশ ক’টি এফএম রেডিও ছাড়াও যোগ হয়েছে নতুন নতুন অনলাইন মাধ্যম। সাম্প্রতিক সময়ে সবচে মাত্রা পেয়েছে মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম। টেলিভিশন, প্রিন্ট বা অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিটি ক্ষেত্রে এখন মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম চালু হয়েছে। তাৎক্ষণিক খবর প্রচারে প্রতিযোগিতা এখন সবার মধ্যে। অনেক মাল্টিমিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ টেলিভিশনের চেয়েও জনপ্রিয় হচ্ছে। মানুষের আস্থা অর্জন করতেও সক্ষম হচ্ছে কেউ কেউ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সাংবাদিকতা বিভাগ ছিল সেটি এখন হয়েছে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।

সেই সঙ্গে ঢাকা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও চালু হয়েছে টেলিভিশন ও ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগ। পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এ সবই ভালো সংবাদ। একই সঙ্গে রয়েছে কিছু বেদনার সংবাদ। পরিধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনে দিনে বাড়ছে গণমাধ্যমের সংকটও। ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্রের সূচনা ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে।

তখন থেকেই সংকট ছিল। ধর্ম, মতাদর্শ ও জনগণের নানা রকম সমস্যা, সংকট এবং কর্মকাণ্ড ছিল প্রধান উপজীব্য। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছিল সব সময়ই। ঊনিশ শতকেই গণমাধ্যমের জন্য সেন্সরশিপ চালু করা হয়েছিল। এখন তা অতিমাত্রায় পৌঁছেছে। অদৃশ্য কালো পর্দায় ঢাকা পড়ে আছে গণমাধ্যমের খোলা জানালা। সাংবাদিকদের ফৌজদারি দণ্ডবিধি ৫০০, ৫০১ বা ৫০২ ধারায় হয়রানি ছিল নিত্য সঙ্গী। এরপর ৫২ ধারা, ৩২ ধারা, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মতো খড়গ যুক্ত হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন আগের দিনের তুলনায় কঠিন হচ্ছে সেবামূলক এ পেশাটি। সংবাদ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধের মামলাকে ফৌজদারি দণ্ড থেকে রেহাই দিয়ে দেওয়ানি বিরোধে রূপান্তরের দাবিটি দীর্ঘদিনের; কিন্তু আওয়ামী শাসনের ১৬ বছরে তারা বিষয়টি আমলে নেয়া প্রয়োজনবোধ করেনি। আমরা দু’চারজন কলাম লিখেছি, টক-শো, সেমিনারে কথা বলেছি। কাজের কাজ কিছু হয়নি। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে আশাও ছেড়েছি। এখন নতুন সরকার এসে সবক্ষেত্রে সংস্কার করছে। ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে সব ক্ষেত্রে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনেও আশা জাগে। হয়তো সাংবাদিকতাও পেশাটিকে নিয়েও কাজ করবে সরকার। যেন কোনো পেশাদার সাংবাদিক সত্য প্রকাশের জন্য হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। সাংবাদিকবান্ধব আইন সংস্কার যা যা প্রয়োজন, তা করবে। এখনও ভয়াবহভাবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে এক ভয়ংকর আইন- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা।

২০১৭ সালজুড়ে এ নিয়ে আলোচনা ছিল তীব্র। এ ধারায় আছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে ব্যক্তি সংগঠনের মাধ্যমে ব্যক্তি বা কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। আলোচনা ছিল সাংবাদিক গুমের খবরও। চোখের সামনে ভাসছে সাগর-রুনি, খুলনার হুমায়ূন কবির বালু, মানিক সাহা, যশোরের মাজেদুর রহমান, সাইফুল আলম মুকুল, ফরিদপুরের গৌতম দাস, শাহজাদপুরের আবদুল হাকিম শিমুলসহ অনেক সাংবাদিকের মুখ। আমাদের সমাজে গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবর যার বিপক্ষে যায়, তখন সেই ক্ষুব্ধ হয়।

পুলিশ, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, মাস্তান, মাফিয়া চক্রসহ বিভিন্ন মহলের সাংবাদিকদের ওপর হামলা-মামলার ঘটনা ঢের। আমাদের দেশে অতীত থেকে চলে আসা কয়েকটি সংবাদপত্র ব্যক্তি বিশেষের মালিকানায় থাকলেও, রাষ্ট্রীয় বিশেষ আনুকল্য (জমি বরাদ্দ, বিজ্ঞাপন, ব্যাংক ঋণ প্রভৃতি) ছাড়া টিকিয়ে রাখা বা লাভজনক রাখা দুরূহ হতো। কিন্তু পরিবর্তিত বাস্তবতায় কর্পোরেট শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোই সংবাদপত্র, টেলিভিশন প্রভৃতি গণমাধ্যমের মালিক হয়ে উঠছে। এসব মালিক ব্যবসাটা আগে বুঝবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে ব্যাহত হচ্ছে সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য। আসলে সংবাদপত্র অথবা টেলিভিশন যা-ই বলুন, তার টিকে থাকা এবং মুনাফানির্ভর করে বিজ্ঞাপনের ওপর। সংবাদও তাই পণ্যে পরিণত হয়েছে। এখন সংবাদপত্র ও টেলিভিশন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং কর্পোরেট অর্থনীতির বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করেই বিশাল মুনাফা শিকারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সেবাকেন্দ্র যখন ব্যবসায় পরিণত হয় তখন সেটা নিশ্চয়ই আর সেবা থাকে না। জাতির বিবেক বলে খ্যাত পেশাটি এখন সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। যারা মানুষের অধিকার-মানবিকতার কথা বলে আজ তারাই বেশি অমানবিকতার শিকার। গেল বছরেই দেখেছি, গার্মেন্টস কর্মীদের মতো সাংবাদিকদেরও রাস্তায় নামতে হয়েছে বেতন-ভাতার দাবিতে। চোখের সামনে সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা না দিয়ে দাপটের সঙ্গে টিকে রয়েছে অনেক গণমাধ্যম। এরপরও স্বপ্ন দেখি আমরা। গণমাধ্যমের আকাশের মেঘ কাটবে। গণমাধ্যম তার দায়িত্ব পালনে অটল থাকবে, ঐক্যবদ্ধ থাকবে সাংবাদিক সমাজ, বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধে ভূমিকা রাখবে। আমরা চাই, বন্ধ থাকা সব গণমাধ্যম খুলে দেয়া হোক। নির্ভয়ে তার দায়িত্ব পালন করুক সব।

লেখক: কথাশিল্পী, গীতিকার ও সাংবাদিক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত