ঢাকা মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে পাট

রত্না খাতুন
পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে পাট

সভ্যতা ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অনাধিকাল থেকে পরিবেশের পরিবর্তন হয়ে আসছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, মহাকাশ অভিযান, নতুন নতুন মারণাস্ত্র উৎপাদন ইত্যাদি নানাবিধ কারণে এ ভূ-মণ্ডলের পরিবেশ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশদূষণ অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ১৯৭০-২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৭ শতাংশ হারে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পেলেও সম্প্রতি এটি ৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে এমনটা হচ্ছে।

বাংলাদেশে মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ২-৩ কেজি। পরিবেশ দূষণের কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরও একটি হলো পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার। পরিবেশবিদদের মতে, প্লাস্টিককে নরম করে পলিথিন তৈরিতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়, যা পরিবেশ সুরক্ষায় মোটেও উপযোগী নয়। এছাড়াও পলিথিনে সিসা, ক্যাডমিয়াম, পারদসহ বিভিন্ন ধরনের ভারি ধাতু রয়েছে। প্লাস্টিক বা পলিথিন তৈরিতে যেসব রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়, তার জন্য মানুষের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, শিশুদের বিকাশে বাধা সৃষ্টি হতে পারে, এমনকি গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলাদের জন্যও ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও পলিথিনের ব্যবহারের জন্য প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, জন্মগত ত্রুটি হওয়া, স্নায়ুতন্ত্র ও কিডনির ক্ষতি হওয়াসহ এমনকি ক্যান্সার হওয়ার মতো বড় ধরনের ঝুঁকিও রয়েছে।

পলিথিন এমন একটি পণ্য, যা মাটির সঙ্গে মিশতে আনুমানিক দেড় হাজার বছর সময় লাগে। পলিথিন মাটির সংস্পর্শে আসার পর ছোট ছোট টুকরায় ভেঙে যায়, যা মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। আমাদের দেশের প্রায় ৭৫ ভাগ মানুষ নানা কাজে পলিথিন ব্যবহার করে থাকে। তাই পরিবেশ রক্ষা করে টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রয়োজন।

সোনালি আঁশ নামে পরিচিত পাট বাংলাদেশের একটি অন্যতম ঐতিহ্যবাহী সম্পদ। উৎকৃষ্ট মাটি ও উপযুক্ত আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশে বিশ্বের সেরা মানের পাট উৎপন্ন হয়। পাট ও পাটজাত পণ্য পরিবেশবান্ধব। পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ করে, ‘কার্বন নিঃসরণ’ হ্রাসে পাটচাষ বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর জীবনকাল ১০০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত। যেখানে একটি বাঁশ জাতীয় বৃক্ষের উৎপাদনকাল ৩-৫ বছর এবং অন্যান্য সব উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি। বনায়ন কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে অন্যতম উপায় হলেও পাটের অবস্থান অন্যান্যের চেয়ে অধিক সাশ্রয়ী।

এটা নবায়নযোগ্য বায়োমাস (Renewable source of biomass) হিসেবে পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। পাট গাছ গড়ে ৭৩০২.৩৮ হাজার টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। এটি প্রতি বছর বাতাসে ৫৩০৯.৯১ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। পাট উৎপাদনকালে হেক্টর প্রতি ৫.০ থেকে ৫.৫ টন পাট পাতা মাটিতে যোগ হয়। পাট গাছে বছরে গড়ে ৯৫৬.৩৮ হাজার টন পাতা এবং ৪২৩.৪ হাজার টন মূল থাকে, যা পচে মাটির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি, জিপসাম, ডলোমাইট, ফেরাস সালফেট প্রদানের মাধ্যমে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। পাটের আঁশ, কাঠি ও শুকনো পাতা নাইট্রোজেন, ফসফরাস পেন্টক্সাইড এবং পটাশিয়াম অক্সাইড নির্গত করে। পাট ফসল কর্তনের পর পাট গাছের গোড়াসহ শিকড় জমিতে থেকে যায় যা পরবর্তীতে পচে মাটির সঙ্গে মিশে জৈব সারে পরিণত হয়। ফলে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় সারের খরচ কম লাগে।

জমির Ligno mass সৃষ্টির ফলে উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এ কারণে যে জমিতে পাট চাষ হয়, সেখানে অন্যান্য ফসলের ফলনও ভালো হয়। পাট জাগ দেওয়ার পর ছালের আঁশ ভিন্ন অন্যান্য নরম পচে যাওয়া অংশ, জাগের ও ধোয়ার তলানি এবং পাট পচা পানি উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। পাট পচনের সময় প্রতি কেজি পাটের ফাইবার থেকে গড়ে ১.৪২৮ কেজি মিথেন নির্গত হয়। এটি পরিবারের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

মানুষের বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসার জন্য আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে পাটের ঐতিহ্যগত ব্যবহার আছে। পাটের ভোজ্য প্রজাতির পাতা প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজসমৃদ্ধ। পাটের মূল হলো ফাইটোমেডিসিনের একটি শক্তিশালী উৎস, যা কার্যকরভাবে কিছু নির্দিষ্ট রোগের সঙ্গে যুক্ত প্রদাহ এবং পাইরেক্সিয়ার চিকিৎসায় কাজ করে।

মাইক্রো এবং ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট ছাড়াও এতে বিস্তৃত বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ আছে, যেমন- গ্লাইকোসাইড, ফেনোলিক্স, ফ্ল্যাভোনয়েড, ট্যানিন, স্যাপোনিন, স্টেরল, ট্রাইটারপেনয়েডস, পোর্ট হাইড্রোম এবং এফএএসি।

পদার্থগুলোতে শক্তিশালী অ্যান্টিপাইরাটিক, মূত্রবর্ধক, ব্যথানাশক, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টিফাঙ্গাল, গ্যাস্ট্রোপ্রোটেকটিভ, অ্যান্টিনোসাইসেপটিভ, অ্যানালজেসিক, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টিটিউমারের ক্রিয়াকলাপের বৈশিষ্ট্য আছে। অধিকন্তু এ পদার্থগুলো আলফা-গ্লুকোসিডেস এবং আলফা-অ্যামাইলেজ ক্রিয়াকলাপকে বাধা দেয় এবং লিভারে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস ও বিটা-অক্সিডেশন বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞানীরা পাটের বীজে পাওয়া বিরল প্রজাতির এন্ডোফাইট ব্যাকটেরিয়ার (স্টাফাইলোকক্কাস হোমিনিস) জিনোম সিকোয়েন্সিং করে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেছেন। গবেষণা অনুসারে, ওই ব্যাকটেরিয়া থেকে কমপক্ষে পাঁচটি অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা এ অভিনব অ্যান্টিবায়োটিককে হোমিকরসিন নামে নামকরণ করেছে। এই অ্যান্টিবায়োটিক বিভিন্ন ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা আছে। পাটের পাতায় ফাইটোলনামক সক্রিয় উপাদান এবং মনো-গ্যালাক্টোসিল্ডি, অ্যাসিলগ্লিসারল শনাক্ত করা হয়েছে। ফাইটোল এবং মনো-গ্যালাক্টোসিল্ডি গ্লিসারল যথাক্রমে এপস্টাইন-বার (ইবি) ভাইরাসের প্রাথমিক অ্যান্টিজেনকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করে। পাটের জলীয় নির্যাসে ক্যান্সার কেমো-প্রতিরোধক উপাদান আছে।

যা টিউমার প্রতিরোধী ক্রিয়াকলাপে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। পাট শাকে থাকা খাদ্য উপাদান মানব শরীরের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। যার ফলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। পাটের বীজ কর্কোর্টক্সিন (স্ট্রাফ্যানথিডিন) কার্ডিয়াক কার্যকলাপ প্রদর্শন করে। কার্ডিয়াক সমস্যায় ব্যবহৃত সবচেয়ে সক্রিয় ওষুধ হলো অলিটোরিসাইড এবং কর্কোরিসাইড, যা পাট থেকে পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা যায়, ভিটামিন বি৬, ফোলেট এবং অন্যান্য ভিটামিন চোখের সমস্যা এবং অন্ধত্ব প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। পাট পাতায় ০.৪৯৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি৬ থাকে। মানব দেহে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণের প্রয়োজন হয় এবং তা হাঁপানি আক্রান্ত মানুষকে শ্বাসকষ্ট এবং শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তি পেতে সহায়ক। পাটের পাতা ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ, যা হাঁপানি প্রতিরোধে বিকল্প ওষুধ হিসেবে কাজ করতে পারে। পাট কাঠির গড় উৎপাদন প্রতি বছর ২৪৮০.৬২ হাজার টন। কাঠের জায়গায় পাট দিয়ে কাগজের পাল্প তৈরি করলে উৎপাদন খরচ কমবে। বছরে প্রচুর পরিমাণে পাট কাঠি সজ্জা, কাগজ এবং গৃহস্থলির জ্বালানির জন্য ব্যবহৃত হয়। পরিবেশবিদদের মতে, একটি দেশে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে মাত্র ১৫.৫৮ শতাংশ বনভূমি। পাটের কাঠি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যা কাঠের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে বন উজাড় কমায়। পাটকে প্রসেসিং করে সহজেই জিও টেক্সটাইল উৎপাদন করা সম্ভব। কম খরচে প্রকৌশল ক্ষেত্রের ল্যান্ডস্কেপের ক্ষয় রোধ করতে জিও-টেক্সটাইল ব্যবহার করা হয়। জিও-টেক্সটাইলে আছে অবক্ষয় রোধের বৈশিষ্ট্য। এ সস্তা এবং পরিবেশবান্ধব পণ্যটিকে নদী বাঁধ, রাস্তা নির্মাণ, বাঁধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।

অত্যন্ত জনবহুল বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে দেশীয় সম্পদ ও টেকসই প্রযুক্তির বিকল্প খুবই নগণ্য। পাটজাত পণ্য শতভাগ বায়োডিগ্রেডেবল এবং রিসাইকেবল। ফলে পাট ও পাটজাত পণ্য পরিবেশবান্ধব।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্লাস্টিক দূষণ রোধে জনগণের মাঝে ভর্তুকিমূল্যে পাটের তৈরি বাজারের ব্যাগ সরবরাহ করা হবে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পলিথিন শপিং ব্যাগের বিকল্প হিসেবে সাধারণ মানুষের মাঝে পাটের ব্যাগ সরবরাহ করা হবে। তিনি আরও বলেন, পাটের ব্যাগ ব্যবহারে সচেতনতা তৈরির জন্য প্রচার কার্যক্রম চালানো হবে।

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত