প্রবীণ জীবন নিয়ে উন্নত দেশগুলো যতটা চিন্তা করে আমাদের দেশ ততটা চিন্তা এখনও করে না। আমাদের বেশিরভাগ প্রবীণ নিয়তি এবং সন্তাননির্ভর। আমাদের প্রবীণরা সামাজিক পরিবর্তনগুলো অনেক সময় মানতে চায় না। নিজেদের সময়কালকে বিবেচনায় নিয়ে মতামত দিতে থাকে। আমরা চাই কিংবা না চাই প্রতিনিয়ত সমাজে পরিবর্তন হয়ে নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা সামনে হাজির হচ্ছে। প্রযুক্তির কল্যাণে কাজের ধরন, কর্মক্ষেত্র, কাজের পরিবেশ, পারিশ্রমিক, কাজের ঘণ্টা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। অতি সম্প্রতি সরকারি সংস্থা এটুআই এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পর দেশে প্রায় ৫৪ লাখ কর্মী চাকরি হারাতে পারেন।
পোশাক খাতে ২৭ লাখ, ফার্নিচার খাতে ১৪ লাখ, কৃষিপণ্য ও পর্যটন খাতে ৬ লাখ করে ১২ লাখ, চামড়া শিল্পে ১ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাবে। অর্থনীতিতে নানা আশঙ্কার পাশাপাশি বিপুল সম্ভবনাও তৈরি হয়। গবেষকরা সেবা খাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয়নি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, হিসাব সংরক্ষণ, রোগ নির্নয়, চিকিৎসা পরামর্শ, শল্য চিকিৎসা, কলকারখানায় নিয়ন্ত্রণ, অফিস আদালতে ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণ, গণপরিবহন চলাচল, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন সক্ষম হবে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে যাবে।
অন্য দিকে যন্ত্রনির্ভর জীবন মানুষের সামাজিক জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। কাজের জায়গায় ঢিলেঢালা ভাব রহিত হয়ে কর্মমুখর হয়ে উঠতে পারে। কাজের চাপ মানুষের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনকে প্রাণহীন, সৌজন্যমূলক, হাই হ্যালোর মধ্যে আটকে রাখবে ।
বস্তুগত অর্জন এবং সুখ ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনকে নিঃসঙ্গ করার প্রবল সম্ভবনা রয়েছে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় অবসর জীবনে চলে আসতে হবে। নিজের দায় দায়িত্ব নিজেকে বহন করতে হবে। খাওয়া দাওয়া, চলাফেরা, দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যক্তির উপর চলে আসতে পারে।
নির্ভরশীলতা প্রবীণ জীবনে অপরিহার্য একটি বিষয়। অতি প্রবীণরা প্রায়ই নিঃসঙ্গ অবস্থায় বসবাস করেন। যারা ছেলে-মেয়ের সঙ্গে থাকার সুযোগ পান তারাও সন্তানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আশার তেমন একটা সুযোগ পান কি না এই বিষয়ে সন্দেহ আছে। সন্তানরা তাদের কর্মজীবন, সন্তান সন্ততি, বন্ধুবান্ধব, সামাজিকতা নিয়ে বেশ খানিকটা ব্যস্ত থাকেন।
আত্মতৃপ্তির জন্য কেউ কেউ দাবি করেন সন্তানের সঙ্গে তার যাপিত জীবন খুবই গভীর এবং আন্তরিক। এসব দাবি অস্বীকার করার জো নাই। প্রশ্ন হলো কত জনের এমন সৌভাগ্য হয়।
এটি প্রমাণিত সত্য মানুষ শেষ পর্যন্ত একা। একা হয়ে যাওয়া কিংবা নিঃসঙ্গ জীবনযাপনকে শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। নিঃসঙ্গতাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারা সাহসের। এই সাহস সবার আছে বলে মনে হয় না।
নিঃসঙ্গ একাকী প্রবীণ জীবনকে শান্তিপূর্ণ ও স্বস্তিদায়ক করতে পেশাদার সেবাকর্মীর প্রয়োজন। অসুস্থ অবস্থায় কিংবা দুর্বল শরীরে দৈনন্দিন কাজকর্ম কারও সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি প্রবীণের মধ্যে কয়েক লাখ প্রবীণ রয়েছে যাদের পেশাদার সেবাকর্মী প্রয়োজন। খুব অল্প সংখ্যক প্রবীণ রয়েছে যারা উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সেবাকর্মী রাখতে পারেন। ভবিষ্যতে সামর্থ্যবান প্রবীণের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। একইসঙ্গে পেশাদার সেবাকর্মীর চাহিদা বাড়বে। সেবাকর্মীর চাহিদা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।
সরকার কতৃক নির্ধারিত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী কমপক্ষে এক বছরের একটি সার্টিফিকেট কোর্স চালু করা দরকার। প্রথম ছয় মাস শ্রেণিকক্ষে তত্ত্বীয় শিক্ষা গ্রহণ এবং বাকি ছয় মাস হাসপাতাল কিংবা সেবাকেন্দ্রে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ শেষে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ। প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার আয়োজন করে সেবাকর্মীদের লাইসেন্স দিতে হবে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত সেবাকর্মীরা হবে পেশাদার সেবাকর্মী। সেবাকর্মীর দায়িত্ব কর্তব্য, নিরাপত্তা, পারিশ্রমিক, ছুটি, কর্মঘণ্টা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা নির্ধারণ করা হবে।
সেবাকর্মীরা যেমন সেবা দেওয়ার দক্ষতা অর্জন করবে এবং একইসঙ্গে অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান সেবা সম্পর্কে ধারণা থাকবে। সেবাকর্মী বাসাবাড়িতে, হাসপাতালে, রোগ প্রশমন কেন্দ্রে প্রবীণের পাশে সাহস এবং নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে উপস্থিত থাকতে হবে। সেবা কর্মীরা জরুরি ভিত্তিতে দুর্গম এলাকা থেকে অসুস্থ প্রবীণকে চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত হাসপাতালে আনতে পারবে। প্রবীণকে নিজ গৃহে অথবা তার পছন্দের জায়গায় চাহিদামোতাবেক সেবাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।
প্রবীণরা পয়সা খরচ করে সেবা গ্রহণ করবে। তারা অবশ্যই সেবাকর্মীর কাছ থেকে সম্মান, মর্যাদা, সৌজন্যতা লাভের অধিকারী হবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রবীণ একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেবাকর্মীর কাছ থেকে সেবা ক্রয় করেছেন। সেবাকর্মীর আচার আচরণ, চলাফেরা শোভন হতে হবে। পরিবারের কোনো সদস্য অথবা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন কিংবা স্থাপনের চেষ্টা চালানো গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে।
সেবাকর্মীরা সম্মানজনক আচার আচরণ করলে সমাজে এই পেশার সম্মান মর্যাদা বেড়ে যাবে। অর্থ বিত্ত, সহায় সম্পদ মানুষকে মানবিক করার পরিবর্তে যান্ত্রিক করে গড়ে তোলার প্রেরণা জোগায়। মানুষ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে যন্ত্রণাদায়ক যান্ত্রিক জীবন। প্রকৃতির বিরুদ্ধ এই যান্ত্রিক জীবন যুদ্ধ বিগ্রহ, ঝড় তুফান, বন্যা জলোচ্ছ্বাস, খরা দুর্ভিক্ষ, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
বাড়ি গাড়ি, সহায় সম্পদ, ক্ষমতার দাপট জীবনের শেষ দিনগুলোতে অর্থ হীন বোঝা হয়ে উঠতে পারে। মৃত্যুকালে আপনজনদের পক্ষে অনেক সময় উপস্থিত থাকা সম্ভব হয় না।
শেষ মুহূর্তে চোখ ভরা জল নিয়ে ছল ছল করে তাকিয়ে হাত খানি ধরে পাশে বসে বিদায় জানাতে আপনজন থাকতে পারবে কি না জানি না। এই সময়টাতে পেশাদার সেবাকর্মীর হাত ধরে শেষ যাত্রার দৃশ্য কল্পনা করতে আমাদের কষ্ট হয়। সেবাকর্মী প্রবীণের শেষ সময়ের ভরসা। সেবাকর্মীর সম্মান মর্যাদা বাড়াতে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
কলাম লেখক