ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

অনাবৃষ্টি ও মৌসুমি ফলনের বিপর্যয়, কৃষির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার সময় এখনই

সেলিম রানা
অনাবৃষ্টি ও মৌসুমি ফলনের বিপর্যয়, কৃষির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার সময় এখনই

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত। অথচ এ দেশের কৃষিব্যবস্থার ভিত্তি এখনও প্রাকৃতিক উপাদানের উপর নির্ভরশীল। বৃষ্টি, বাতাস, তাপমাত্রা, ঋতুচক্র এই সবকিছুই কৃষির সফলতাণ্ডব্যর্থতার গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। তবে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ঋতু যেমন অনিয়মিত হয়ে উঠছে, তেমনি কৃষিও পড়ছে একের পর এক সংকটে। চলতি বছর অনাবৃষ্টির দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এবং তার সঙ্গে যোগ হওয়া আকস্মিক শিলাবৃষ্টি দেশের মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এর প্রভাব সরাসরি কৃষকের জীবনধারা, অর্থনীতি এবং খাদ্যনিরাপত্তার উপর পড়ছে।

মে-জুন মাস বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন মৌসুম। এই সময়টিকে ফলের মৌসুম বললে অত্যুক্তি হবে না। দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের বহু চাষি এই সময়ে আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, তেঁতুল, বেল ইত্যাদি ফল চাষের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই ফলগুলো শুধু পুষ্টির জন্যই নয়, দেশের অর্থনীতির একটি শক্তিশালী খাত হিসেবেও বিবেচিত। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার মৌসুমি ফল বাজারজাত হয়, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর বাজারে যায়। অথচ এই বছর সেই মৌসুমি ফলন ব্যাহত হয়েছে ভয়াবহভাবে।

অনাবৃষ্টির কারণে মাটিতে প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা না থাকায় গাছ ফলের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি শোষণ করতে পারেনি। অনেক গাছে মুকুল এলেও তা ঝরে গেছে, আবার যেসব গাছে ফল এসেছে, তা আকারে ছোট এবং স্বাদেও কম। চাষিরা জানান, ‘বছরের পর বছর ধরে আমরা গাছ লালন করছি, এবার মনে হচ্ছে ফলন তেমন কিছুই হবে না।’ মুকুল ঝরে পড়া, ফল ফেটে যাওয়া, সময়ের আগেই ঝরে পড়া এসব সমস্যা এবার ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, নওগাঁ, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর ও টাঙ্গাইলের চাষিরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

যখন কৃষকরা অনাবৃষ্টির ধকল সামলে উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই হঠাৎ কিছু কিছু স্থানে শিলাবৃষ্টি এসে তাদের স্বপ্ন ভেঙে দিল। এপ্রিল ও মে মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কয়েকবার আকস্মিক শিলাবৃষ্টি হয়েছে। এই শিলাবৃষ্টি শুধু ফলনকেই ধ্বংস করেনি, গাছের ডালপালাও ভেঙে ফেলেছে। শিলার আঘাতে অনেক অপরিপক্ব আম ও লিচু মাটিতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু মৌসুমি ফল নয়, বর্ষা-পূর্ববর্তী সময়ে যেসব সবজি চাষ হয়, যেমন শিম, লাউ, করলা, বরবটি ইত্যাদির ক্ষেতেও একই রকম প্রভাব পড়েছে। এতে করে কৃষকের লোকসান দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে শুধু ফলের দামই বাড়বে না, সবজির বাজারেও এর প্রভাব পড়বে।

জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এই অনিয়মিত মৌসুম ও চরম আবহাওয়া। গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হওয়া এবং হঠাৎ শিলাবৃষ্টির মতো চরম আবহাওয়া ইঙ্গিত দেয়, বাংলাদেশের মতো নিম্নাঞ্চলীয় কৃষিনির্ভর দেশগুলো কী ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে। বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি, গ্রীনহাউস গ্যাস জমে থাকা, গাছপালা নিধন, জলাভূমি ধ্বংস, এবং নির্বিচারে নদীভরাট এই পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি। অথচ এসব ঘটনার জন্য দায়ী মূলত উন্নত দেশগুলো, আর ভুক্তভোগী হচ্ছে আমাদের মতো কৃষিনির্ভর উন্নয়নশীল দেশ। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকারের কিছু দ্রুত ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। প্রথমত, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জরুরি সহায়তা দিতে হবে নগদ প্রণোদনা, বিনামূল্যে সার-বীজ, কৃষিঋণ মওকুফ ও পুনঃঋণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আবহাওয়া পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা গ্রামপর্যায়ে পৌঁছে দিতে আরও উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প চালু করে কৃষকদের পানির ওপর নির্ভরতা কমানো, ভূগর্ভস্থ জল সংরক্ষণ এবং খাল-বিল-পুকুর খনন ও পুনঃখননের ব্যবস্থা করতে হবে। চতুর্থত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কৃষি তথ্যসেবার মাধ্যমে জলবায়ু সহনশীল চাষাবাদে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রেরণা দিতে হবে। এছাড়াও, জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের একটি মারাত্মক সংকট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর প্রভাব শুধু পরিবেশে নয়, মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, বন্যা, সাইক্লোনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে এই জলবায়ু পরিবর্তন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত