বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোরবানির ঈদ। প্রতি বছর এই ঈদকে ঘিরে গরু-ছাগলের হাট, নতুন পোশাক, খাবার, উপহার আদান-প্রদানসহ নানা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বাড়ে। অর্থনৈতিক লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এক শ্রেণির প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ সময় জাল টাকার সরবরাহও আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। জাল টাকা ছড়িয়ে পড়ার ফলে শুধু সাধারণ জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হন না, দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ে। এই প্রবন্ধে কোরবানির ঈদকে ঘিরে জাল টাকার বিস্তার, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা এবং সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হবে।
ঈদ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার : কোরবানির ঈদ ঘিরে বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন ঘটে। কোরবানির পশু কেনাবেচা, পশু পরিবহন, হাট ইজারা, চামড়ার ব্যবসা, পোশাক, জুতা, খাদ্যসামগ্রী এবং নানা ধরনের পণ্যের বেচাকেনায় যে অর্থনৈতিক গতি তৈরি হয়, তা দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সময়ে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়ে, অনেক মানুষ ব্যাংকের বাইরে নগদ লেনদেন করে। এতে করে প্রতারক চক্রের সুযোগ তৈরি হয়।
জাল টাকা তৈরির চক্র এই সময়ে বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে পশুর হাটগুলোতে জাল নোট ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কারণ, হাটে নগদ লেনদেন বেশি হয় এবং হাটে থাকা ক্রেতা-বিক্রেতারা প্রায়ই যাচাই করার সুযোগ বা প্রযুক্তি পান না।
জাল টাকার ইতিহাস ও বর্তমান চিত্র : বাংলাদেশে জাল টাকার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। এক সময় এই কাজটি সীমান্তবর্তী কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে রাজধানীসহ বড় বড় শহরে এর বিস্তার ঘটেছে। কিছু চিহ্নিত চক্র স্থানীয়ভাবে টাকা ছাপায়, আবার অনেক ক্ষেত্রে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে জাল টাকা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বর্তমানে যে ধরনের জাল টাকা বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলো আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি হওয়ায় আসল ও নকলের পার্থক্য বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট সবচেয়ে বেশি জাল হয়, কারণ এগুলোর মাধ্যমে বড় লেনদেন করা যায়। পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রতি বছর ঈদের আগে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা ও জালিয়াত চক্রের সদস্যদের আটক করলেও এই অপরাধ সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়নি। কারণ, এর সঙ্গে বড় একটি অপরাধ সিন্ডিকেট জড়িত, যারা দেশজুড়ে একটি সংগঠিত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করে। পশুর হাটে জাল টাকার ছড়াছড়ি : ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশালসহ বড় বড় শহরের কোরবানির পশুর হাটে জাল টাকা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো একজন ক্রেতা ৫০ হাজার বা এক লাখ টাকার একটি গরু কিনে ১০-১৫টি জাল ৫০০ টাকার নোটের সঙ্গে আসল টাকা মিশিয়ে দেয়। বিক্রেতা হাটের ভিড় ও দ্রুত লেনদেনের চাপে তা যাচাই করতে পারে না। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে পশু নিয়ে শহরের হাটে আসে, তারা নগদ টাকার নিরাপত্তা এবং যাচাইয়ের বিষয়ে অজ্ঞ থাকায় প্রতারকের ফাঁদে পড়ে যায়। জাল টাকা গ্রহণ করে তারা শুধু অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, অনেক সময় আইনগত বিপদেও পড়ে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা : প্রতি বছর কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ নজরদারি ও অভিযান চালায়। র্যাব, ডিবি, পুলিশ, এনএসআইসহ বিভিন্ন সংস্থা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জাল টাকার কারখানাগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। অনেক সময় বিপুল পরিমাণ জাল টাকা, প্রিন্টিং মেশিন, কাঁচামাল এবং ডিজিটাল সরঞ্জাম উদ্ধার হয়। তবে এদের বেশিরভাগই বিচ্ছিন্ন অভিযান। মূল চক্র বা মাফিয়াদের ধরতে দীর্ঘমেয়াদি গোয়েন্দা কার্যক্রম ও প্রযুক্তিনির্ভর তদন্ত প্রয়োজন। আবার অনেক সময় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবের কারণে এসব অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করে, যাতে তারা জাল টাকা শনাক্তের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মাঝে সেই প্রযুক্তি বা জ্ঞানের অভাব রয়েছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব : জাল টাকা শুধু ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, এটি সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। জাল টাকা ছড়িয়ে পড়লে বাজারে আসল টাকার মূল্যহ্রাস ঘটে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে এবং জনগণের মাঝে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া একজন নিরীহ বিক্রেতা জাল টাকা হাতে পেলে তার সব শ্রম বৃথা যায়, যা সামাজিকভাবে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়।
বিশেষ করে পশুর হাটে জাল টাকা পেয়ে কৃষক ও খামারিরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। একদিকে গরু পালন ও পরিবহনে তাদের খরচ হয়, অন্যদিকে পুরো আয় জাল টাকার মাধ্যমে নষ্ট হয়ে গেলে তারা ভবিষ্যতে পশু পালন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতে কোরবানির পশুর উৎপাদনেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে।
আইনি কাঠামো ও বিচার প্রক্রিয়া : বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪৮৯ ধারায় জাল টাকা তৈরি, বিতরণ, রাখা ও ব্যবহার কঠোর অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে বাস্তবে দেখা যায়, অনেক সময় মামলাগুলো প্রমাণের অভাবে ঝুলে থাকে বা অপরাধীরা জামিন পেয়ে যায়। এছাড়া, তদন্তে ধীরগতি, সাক্ষীর অভাব, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব এবং বিচারব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক চক্র রয়ে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
সচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা : জাল টাকা প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা। মানুষ যদি সচেতন হয় এবং জাল টাকা চেনার পদ্ধতি জানে, তাহলে প্রতারকদের ঠেকানো সম্ভব হবে। ব্যাংক, গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন এবং স্থানীয় প্রশাসন একযোগে কাজ করলে সাধারণ জনগণকে সচেতন করা সহজ হবে। বর্তমানে মোবাইল অ্যাপ, ইউটিউব ভিডিও, পোস্টার ও লিফলেটের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাল নোট চেনার পদ্ধতি তুলে ধরছে। তবে এই কার্যক্রম আরও সম্প্রসারণ দরকার, বিশেষ করে পশুর হাটগুলোতে প্রজেক্টরের মাধ্যমে ভিডিও প্রদর্শন, স্থানীয় ভাষায় মাইকিং এবং হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।
প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান : জাল টাকা প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। পশুর হাটগুলোতে জাল টাকা শনাক্তকারী মেশিন সরবরাহ, ব্যাংক ও বিক্রেতার মাঝে ডিজিটাল লেনদেন উৎসাহিত করা, ছজ কোড ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। এতে নগদ টাকার ব্যবহার কমে যাবে এবং প্রতারণার সুযোগ কমে আসবে।
বর্তমানে নগদ, বিকাশ, রকেটসহ মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসগুলোকে পশুর হাটে প্রমোট করে ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ তৈরি করা গেলে একদিকে জাল টাকা প্রতিরোধ হবে, অন্যদিকে প্রযুক্তিনির্ভর লেনদেনের অভ্যাস গড়ে উঠবে। পরিশেষে বলতে চাই, কোরবানির ঈদে জাল টাকার বাজার সয়লাব হওয়া শুধু আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা নয়, এটি আমাদের অর্থনীতি, সমাজ ও নৈতিকতার চিত্রও তুলে ধরে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন বহুমাত্রিক উদ্যোগ- আইনি কঠোরতা, প্রযুক্তির ব্যবহার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এবং সর্বোপরি জনসচেতনতা। প্রতিটি নাগরিককে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং সন্দেহভাজন কোনো লেনদেন বা ব্যক্তি সম্পর্কে প্রশাসনকে অবহিত করতে হবে। কোরবানির ঈদের আনন্দ যেন কারও প্রতারণার ফাঁদে পরিণত না হয়- এটাই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।
লেখক : সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি