ঢাকাসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। তবে অন্য অঞ্চলের তুলনায় রাজধানীতে অপরাধ বেশি বেড়েছে। চুরি, ছিনতাই, খুন ইত্যাদি ক্রমেই বাড়ছে। অপরাধীরা এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তারা পুলিশের উপর আক্রমণ করতেও দ্বিধা করছে না। এতে নগরবাসী আতঙ্ক ও শঙ্কায় রয়েছে। অন্যদিকে, পুলিশের নিস্ক্রিয়তা ও গাফিলতিও রয়েছে। মোহাম্মদপুর, মগবাজার, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এমনকি তারা এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় গিয়ে অপরাধ করছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারন করবে বলে অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে তারা দেশের শোচনীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বেকারত্ব, অভাব-অনটন ইত্যাদিকে দায়ী করছেন। অন্যদিকে, মব ভায়োলেন্স, রাজনৈতিক অস্থিশীলতা, পুলিশের যথাযথ দায়িত্ব পালন না করাও অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এছাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও দখলদারিত্ব নিয়ে বিরোধের কারণে অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত সোমবার মধ্য বাড্ডায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে এক বিএনপি নেতা খুন হয়েছেন। গতকাল মিরপুরে এক ব্যবসায়িকে প্রকাশ্যে গুলি করে ২২ লাখ টাকা ছিনতাই করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সিসিটিভির ক্যামেরায় ধারণকৃত বেশ কয়েকটি ছিনতাই ও খুনের ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এসবের ভয়াবহতা দেখে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে আগামী দিনগুলোতে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ী ও মানুষের যাতায়াত এরইমধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই ঘরমুখো মানুষের ঢল নামবে। বাস, ট্রেন ও লঞ্চ স্টেশনগুলোতে ভিড় বাড়বে। অপরাধীরা সবসময়ই এসময় মানুষের অর্থকড়ি ও মালামাল লুটের জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। মার্কেটগুলোতে পকেটমার, ছিনতাইকারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এসময়কে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। গত ঈদে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সক্রিয় থাকায় মানুষ স্বস্তিতে ঈদযাত্রা ও সময় পার করতে পেরেছে। এবার ঈদের আগেই আপরাধীরা অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ও অনিরাপত্তাবোধ কাজ করছে। মানুষ স্বস্তিতে চলাচল করতে দ্বিধান্বিত। অপরাধ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা দেশের অর্থনীতির খারাপ পরিস্থিতির কথা বলেছেন। সরকারের প্রায় দশ মাস হয়ে গেলেও অর্থনীতিকে গতিশীল করতে পারেনি। সরকারের হাতে যেমন টাকা নেই, মানুষের হাতেও টাকা নেই। হু হু করে বেকারত্ব বাড়ছে। দারিদ্র্যসীমা আরও নিচে নেমেছে। গতকাল পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ বছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ২১ লাখের বেশি কর্মজীবী চাকরি হারিয়ে বেকার হয়েছে। এরইমধ্যে শত শত শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয় সংকুলান করতে পারছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি কমে গেছে। বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। এতে নতুন কর্মসংস্থান হওয়া দূরে থাক, কর্মরতরা ছাঁটাইয়ের শিকার হচ্ছেন। সাধারণ মানুষকে এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সংসার চালানো নিয়ে তাদের দুঃশ্চিন্তার মধ্যে দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। অনেকের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চার হচ্ছে। এ থেকে অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠছে। অপরাধে নতুন নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে। তরুণদের মধ্যকার হতাশা তাদের অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যে কিশোর গ্যাং বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, এগুলো অভাব-অনটনের বাই প্রোডাক্ট। তাদের পরিবার অভাব-অনটনে থাকায় এবং সন্তানদের ঠিকমতো ভরণপোষণ করতে না পারায় তারা অপরাধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি ও গতিশীল করতে না পারলে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও বেকারত্ব গুচাতে না পারলে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে অপরাধ ও অপরাধীকে গ্রেপ্তার এবং নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও তাতে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া যেতে পারে। তবে অপরাধের মূল কারণ ও উৎস চিহ্নিত করে সমাধান করতে না পারলে তা বাড়তেই থাকবে। পুরোনো অপরাধীর সঙ্গে নতুন অপরাধী যুক্ত হবে। সরকার অনেক সংস্কার কাজে হাত দিয়েছে। তবে মানুষের নিরাপত্তা ও জানমালের হুমকি হয়ে থাকা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যে সংস্কার প্রয়োজন, তার উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। পুলিশকে এখনও কার্যকর অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। তারা যেন নামকাওয়াস্তে দায়িত্ব পালন করছে। এতে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ম্যাজেস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়ে মাঠে সেনাবাহিনী থাকলেও অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কমছে না। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে মানুষের মাঝে আতঙ্ক বাড়বে বৈ কমবে না। তাদের ঘরেও শান্তি নেই, বাইরেও স্বস্তি নেই। মানুষকে স্বস্তি ও নিরাপত্তা দিতে হলে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান এখন সময়ের দাবি। এরইমধ্যে সেনাবাহিনী ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করতে তার তরফ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছে। ঈদ সামনে রেখে মানুষের চলাচল স্বাভাবিক ও নিরাপদ রাখতে তাদের সক্রিয় হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অপরাধী যে-ই হোক, তাদের কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। তাদের দ্রুত গ্রেপ্তর ও আইনের আওতায় এনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সরকারকে অর্থনীতি গতিশীল করতে, বেকারত্ব গুচাতে ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান কীভাবে খোলা ও সচল করা যায়, সে পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিতে হবে।