স্বনির্ভর একটা জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের দেখতে চাই। খাদ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাইরে থেকে যেন আমদানি করতে না হয় তার জন্য সবাইকে চেষ্টা করে যেতে হবে। আমার ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের গ্রামের অনেক পরিবারে চাষের ব্যবস্থা ছিল। ধান কাটার মৌসুমে অনেক বাড়িতে আনন্দ লেগেই থাকত। এখন গ্রামে যখন যায় সেই ছোটবেলার ধানের গন্ধ পাওয়া যায় না। ‘গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ’ এই প্রবাদটা আর আমাদের দেশে অনেক জায়গায় কার্যকর হচ্ছে না। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে দেশের অনেক গোলাশূন্য হয়ে আছে। এখন চাউল বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। যে চাউল আপনি কয়েক বছর আগে ৪০ টাকা দিয়ে কিনেছেন, সে চাল এখন ৭০ থেকে ৮০ টাকা দিয়ে কিনছেন। সার, কীট নাশক, সেচ খরচ, শ্রমিক যে হারে বেড়েছে, সেই হারে বাড়েনি ফসলের দাম। ফলে লাভের মুখ দেখতে ব্যর্থ হচ্ছেন কৃষকরা।
আবার যখন কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেয়, তখন ফসলের দাম বাড়ে কিন্তু সে সময় কৃষকের গোলা থাকে বলতে গেলে শূন্য। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন কমছে আমাদের ফসলি জমি ও ফসল। অথচ একসময় আমাদের মাতৃভূমি সোনার বাংলার খেত-খামার সোনালি ফসলে পরিপূর্ণ থাকত। আবাদি জমি ভাগ হয়, বাড়িঘর তোলে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জমি কমে, ধানের ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমে। এদিকে, কৃষিজমি কমা মানেই কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়া। আর সেক্ষেত্রে উৎপাদন কমে গেলে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারটি সরকারের জন্য কঠিন হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন। বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হচ্ছে, বিশেষ করে জীব-বিজ্ঞানের। কৃষিজমি কমছে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন কমবে। কিন্তু যদি উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়, কম জমিতে, কম সময়ে বেশি ফসল ফলানো যায় তাহলে অবশ্যই অনেক ভালো হবে।
গ্রামের কৃষিজমি দ্রুত অকৃষি খাতে যাচ্ছে। সংরক্ষিত ভূমি বলতে কিছু নেই। তবে জলাধার, বন, পাড়ার রক্ষায় আইন ও নীতিমালা থাকলে সরকারের মনিটরিংয়ের অভাবে এর তোয়াক্কা করছেন না কেউ। ভূমিদস্যুদের কাছে এসব আইন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা অসহায়! নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন জমি কমার মূল কারণ। দ্রুত ভূমি রক্ষায় সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ না করলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা গেছে, প্রতিবছর দেশের ৬৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর চাষাবাদ যোগ্য জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৭৬২ মিলিয়ন হেক্টর। গত ৩৮ বছরের এ জমির পরিমাণ কমেছে ১ দশমিক ২৪২ মিলিয়ন হেক্টর। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের জন্য কৃষিজমি অকৃষি জমিতে পরিণত হচ্ছে। শিল্পায়ন ও আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য কি প্রকারের ভূমি ব্যবহার করা দরকার সে বিষয় নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়া ফল ও সবজি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তাই আমাদের বাড়ির আঙিনায় যতটুকু খালি ও পতিত জায়গা রয়েছে এবং শহরের বাসাবাড়ির ছাদে যথাযথ ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা করে খুব সহজেই নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস আবাদ করে সতেজ খাবার আমরা গ্রহণ করতে পারি তার পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৮৬ সালে আবাদি যোগ্য জমি ছিল ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর। ২০০০ সালে তা কমে ৭১ লাখ ৯ হাজার হেক্টরে আসে। ২০০৩ সালে ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টরে এসে দাঁড়ায়। গড়ে প্রতিবছর ৪০ হাজার একর আবাদি জমি হারাচ্ছে। কৃষিজমির অপচয় বা নষ্ট করে অবাধে অপরিকল্পিত এ আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে দেশের অর্থনীতিতে যে বিরুপ প্রভাব পড়ছে তা থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজে বের করতেই হবে। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে খাদ্যশস্য আমদানি করে দেশের খাদ্য সমস্যা দূর করার যে অলীক স্বপ্ন কিছু মানুষ দেখেন তা অবাস্তব স্বপ্ন দেখারই নামান্তর।
কৃষির এই দূরাবস্থা দূর করতে জাতীয়ভাবে নীতি গ্রহণ করতে হবে। শিল্প-কারকানা, রাস্তাঘাট এবং আবাসস্থলের জন্য জমির প্রয়োজনীতাকে অস্বীকার না করে সুষ্ঠু নীতিমালা গ্রহণের মধ্যদিয়ে কৃষক এবং কৃষিকে আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে যুগোপযোগী করা তোলার এখনি সময়। কৃষিজমির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, তদারকি ও রক্ষায় আমরা যেন এখন একেবারেই নির্বিকার। আর এ কারণেই আমাদের আহারের জোগান হয়, যে জমি থেকে সেই কৃষিজমি বহুবিধ কারণে এখন কমে আসছে। সেই কমে আসাটা ভয়ংকরও বটে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণ, নদীভাঙন, ইটভাটা, কলকারখানা স্থাপন, বাগানবাড়ি, রিসোর্ট- এসব নানা কারণেই কমে আসছে কৃষিজমি। প্রতিদিনই কৃষিজমি কমছে। যে হারে কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে, সে হারে এই ধারাবাহিকতা চলমান থাকলে আগামী ২০৫০ অথবা ২০৬০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে কৃষিজমির অবস্থা খুব বেশি খারাপ হয়ে পড়বে। কৃষিজমি নষ্ট হলে ধীরে ধীরে খাদ্যনিরাপত্তাও সংকুচিত হয়ে আসবে। তাই কৃষিজমি ব্যবহার করে অপরিকল্পিত রাস্তাাঘাট, দালানকাঠা, বাসভবন নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চলের বাইরে কৃষিজমির ওপর যত্রতত্র ছোট-বড় শিল্প-কলকারখানা, বাণিজ্যিক পার্ক, বাগান বাড়ি নির্মাণ বন্ধে আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিজমিতে ইটভাটা নির্মাণ, বেচাকেনা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ঘোষণা করতে হবে। একটা সময় দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবায় প্রবহমান ছিল প্রচুর পরিমাণ মিঠাপানি। যে প্রবাহে জলাশয়গুলো ব্যবহৃত হতো সুস্বাদু মাছের চারণভূমিরূপে।
সেই নদীর দেশ আর পুকুরভরা মাছের দেশ বাংলাদেশ এখন প্রায় খাল-বিল, নদী-নালা শূন্য। খাল-বিল ভরাট করে চলছে নানা স্থাপনা তৈরির মহোৎসব। আর যেসব এখনও অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলোতে দূষণের মাত্রা এত বেশি যে মাছের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। এ ছাড়াও কৃষিজমিতে ব্যবহার করা কীটনাশক বৃষ্টির পানি বা সেচের মাধ্যমে বিল ও জলাশয়গুলোতে গিয়ে পড়ায় মাছের বেঁচে থাকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে আমাদের চেনা-অচেনা মাছগুলো। মলা, ঢেলা, চেলা, টেংরা, পুঁটি, কাচকি মাছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, আয়োডিন, মিনারেল, ফসফরাস ও ভিটামিন-এ থাকে। বিশেষ করে মলা ও ঢেলা মাছে তো থাকে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-এ, যা বাড়ন্ত শিশুদের ‘জেরক থালমিয়া’ রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। জানা যায়, ভিটামিন-এ’র অভাবে গড়ে প্রতিবছর ৩০ হাজার শিশু অন্ধত্ববরণ করে। এ ছাড়া মা ও শিশুর রক্তশূন্যতার অভাব ছোট মাছের দ্বারা পূরণ করা যায় সহজেই। মাছের প্রোটিন অন্যান্য প্রাণিজ প্রোটিনের মতোই রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। মাছে যে ওমেগা ও ফ্রি ফ্যাট অ্যাসিড থাকে, তা রক্তের অণুচক্রিকাকে রক্তজমাট বাঁধতে দেয় না। বিশেষ করে মলা, ঢেলা, রিটা, শিং, মাগুর, কৈ মাছ চোখের জন্য অত্যন্ত উপকারী। গ্রামে এক সময় পৌষ-মাঘ মাসে পুকুর, খাল, ডোবা, ঘের থেকে দেশি মাছ ধরার ধুম পড়তো। এখন অনেক অনেক গ্রামে দেশীয় মাছ নেই বললেই চলে। শীতকাল ছাড়া বর্ষাকালে ধানি জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও চাই পেতে মাছ ধরার রীতিও হারিয়ে গেছে অনেক এলাকা থেকে।
যারা একসময় পুকুর, খাল-বিল, ডোবা, নালায় মাছ ধরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতো তাদের অনেকেই এখন বাজার থেকে মাছ কিনতে বাধ্য। গ্রামের এই সুস্বাদু মাছগুলো এখন প্রায় সোনার হরিণ হয়ে গেছে। মাছের বিচরণ এলাকা নদী, হাওর-বাঁওড় ও বিল দূষিত হয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর চারপাশের নদী বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, বালু, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে মাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। জানা গেছে, দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০টি আগ্রাসী প্রজাতির বিদেশি মাছ ঢুকে পড়েছে, যা দেশি ছোট মাছগুলো খেয়ে সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। দেশের কৃষিকাজে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ টন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহৃত হয়, যা মাটি চুইয়ে জলাভূমিতে যায়। এর কারণে মাছের উৎপাদন কমছে। শুধু দেশি জাত ও স্বাদের মাছই নয়, এর সঙ্গে কচ্ছপসহ নানা ধরনের জলজ প্রাণী ও প্রতিদিন কমে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি মানুষ অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে অসুস্থ হয় এবং এর থেকে মারা যায় প্রায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া ৫ বছরের নিচে কম বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশ শিশু অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে অসুস্থ হয় যার থেকে প্রতি বছর ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা ৯ বিলিয়ন হবে এবং খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাবে ৮৫ শতাংশ। এর মধ্যেই তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রভাব তার সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাপক খাদ্য সংকটের ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ এখনও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে বিশ্বে এখনও প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ খাদ্যের অভাবে ভুগছে। তাই চলুন সবাই বিভিন্নমুখী উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি আত্মনিয়োগ করি, যাতে দুর্ভিক্ষের কালো থাবা আমাদের ওপর আঘাত না করে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট