চামড়া শিল্প হলো এমন একটি শিল্প- যা প্রাণীর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে তাকে প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহারযোগ্য চামড়ায় রূপান্তর করে এবং এরপর সেই চামড়া দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে, যেমন : জুতা, ব্যাগ, বেল্ট, পোশাক, আসবাবপত্রের আসন, খেলাধুলার সরঞ্জাম, গাড়ির সিট কাভার ইত্যাদি। এই শিল্পে প্রধানত গবাদিপশুর (গরু, ছাগল, মহিষ ইত্যাদি) চামড়া ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিমুখী খাত হলো চামড়া শিল্প। বিশেষ করে ঈদুল আজহার পর প্রচুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয়, যা প্রক্রিয়াজাত করে দেশে এবং বিদেশে বিক্রি করা হয়। হেমায়েতপুর, সাভার এবং নারায়ণগঞ্জে এই শিল্পের অনেক কারখানা রয়েছে।
বাংলাদেশের চামড়া শিল্প এক সময় রপ্তানি আয়ের একটি সম্ভাবনাময় খাত ছিল, কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এই শিল্পের উন্নতির পরিবর্তে ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। এর পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। যেমন অপর্যাপ্ত ও অকার্যকর ট্যানারি স্থানান্তর (সাভার ইস্যু), হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের পর সাভারে একটি ট্যানারি কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হয়। কিন্তু সেখানে এখনো পূর্ণাঙ্গ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যকরভাবে চালু হয়নি। ফলে পরিবেশবান্ধব না হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ঈদুল আজহার পর চামড়া ঠিকভাবে সংরক্ষণ না হওয়ায় হাজার হাজার কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়। আন্তর্জাতিক মান ও বাংলাদেশের অনেক চামড়া কারখানায় সার্টিফিকেশন নেই। এই সার্টিফিকেট ছাড়া ইউরোপ-আমেরিকার অনেক বড় ব্র্যান্ড পণ্য গ্রহণ করে না। কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিক্রির ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব বেশি। এতে কৃষক, কসাই বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ন্যায্য দাম পান না। পরিবেশগত সমস্যার কারণে চীন, ইউরোপ ও আমেরিকান বাজারে চামড়ার রপ্তানি কমে গেছে।
অন্যদিকে, ভারত ও পাকিস্তান চামড়া রপ্তানিতে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে। এছাড়াও অর্থনৈতিক নীতির দুর্বলতা ও সরকারের যথাযথ নজরদারির অভাব। নীতিনির্ধারণ, রপ্তানি প্রণোদনা ও শিল্প সহায়তায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতার অভাব রয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ শ্রমিকের অভাবে উৎপাদনের মান আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারে না। বাংলাদেশের চামড়া শিল্পে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতা, অব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে না পারার কারণে এই খাত ধ্বংসের মুখে পড়ছে। ‘চামড়া শিল্প বাঁচাব কীভাবে?’ এটি শুধু একটি প্রশ্ন নয়, বরং একটি জাতীয় অঙ্গীকার হওয়া উচিত। বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময়, রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে চামড়া খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাইলে আমাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। চামড়া শিল্প বাঁচাতে করণীয়, ট্যানারি ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও পরিবেশবান্ধব রূপান্তর। ট্যানারিগুলোতে দ্রুত সম্পূর্ণ কার্যকর চালু করতে হবে।
শিল্পাঞ্চলে পরিবেশ আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। পরিবেশবান্ধব ট্যানারিকে সাবসিডি বা কর সুবিধা দিতে হবে। চামড়া সংরক্ষণের জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা ও প্রতিটি জেলায় কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ ও লবণ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ ও তদারকি জোরদার করতে হবে।
বাজার নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। কাঁচা চামড়ার ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে সরকার নির্ধারিত মূল্যে কেনাবেচার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতি, সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব দূর করতে হবে। শুধু কাঁচা চামড়া নয়, প্রসেসড লেদার ও প্রস্তুত পণ্য (জুতা, ব্যাগ, ওয়ালেট, বেল্ট) রপ্তানিতে জোর দিতে হবে। নতুন আন্তর্জাতিক বাজার যেমন- আফ্রিকা, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশের কৌশল নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক মান অর্জন ও সার্টিফিকেশন ইত্যাদি অর্জনে সরকারী সহায়তা দিতে হবে। এসব মান না থাকলে বিদেশি ক্রেতারা আগ্রহ হারায়। চামড়া প্রক্রিয়াকরণ, ডিজাইন, প্রোডাকশন, মার্কেটিং সব পর্যায়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিশেষ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট কে আধুনিকীকরণ করতে হবে। উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ প্রদান করে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ ও প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা যেতে পারে। সরকার, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, স্থানীয় প্রশাসন ও ভোক্তাদের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। গণমাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে যে ‘চামড়া শিল্প বাঁচলে, দেশ বাঁচবে’। চামড়া শিল্প বাঁচাতে হলে এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা, সরকারি উদ্যোগ এবং বেসরকারি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এটি শুধু একটি শিল্প নয়, এটি লাখো মানুষের জীবিকা, বাংলাদেশের রপ্তানির গৌরব এবং অর্থনীতির একটি শক্তিশালী স্তম্ভ।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সাংস্কৃতি, ঢাকা কলেজ