ফ্যাসিবাদ-উত্তর দেশের মানুষ যেমন অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, ঠিক তেমনিভাবে আধুনিক সময়ের একটি টেকসই বাংলাদেশ দেখার আকাঙ্ক্ষায় রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারও চান। সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী জমানার সব অপকর্মের বিশেষ করে গুম-খুন এবং জুলাই গণহত্যার ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন। কোনো অজুহাতে নাগরিকদের এই চাওয়া পূরণ না হলে আবার জনহতাশা ভিন্নভাবে বিস্ফোরিত হতে পারে। সেটি কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচন নিঃসন্দেহে একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে এটি বাস্তবে যতটা কার্যকর, গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরাচারী শাসন চেপে বসা রাষ্ট্রে ঠিক ততটাই ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার বৈধতা দেওয়ার সিলমোহর মাত্র।
বাংলাদেশে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর শেখ হাসিনা তার স্বৈরশাসনের বৈধতায় পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেন। যেখানে বিরোধী দলের কোনো স্থান ছিল না। বিরোধী দলশূন্য নির্বাচন করে শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন স্থায়ীভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে। ফলে গত দেড় দশক ধরে আমাদের দেশে নির্বাচন ছিল নির্বাসিত। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিজয় ঘোষণাই ছিল অঘোষিত নিয়ম। সঙ্গত কারণে দেশের মানুষ শেখ হাসিনার জুলুমশাহীর অবসানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন। সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ দেশবাসীর কাছে ধরা দেয় চব্বিশে ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনে। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যখন ফ্যাসিবাদী শাসনের কড়াল গ্রাস থেকে মুক্তি পান দেশবাসী। এতে দেশে আবার গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসার সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গঠিত হয়েছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার ১০ মাসের বেশি সময় ধরে দেশ পরিচালনা করছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দীর্ঘ ৫৩ বছরের অবিচার অন্যায় বৈষম্য এবং দুঃশাসন থেকে মুক্তি চায় জনগণ। এটিই চব্বিশের অভ্যুত্থানের জন-অভিপ্রায়। জনগণের এ প্রত্যাশা পূরণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্রের নানাবিধ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি দেশে যাতে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটে, সেই মতো নির্বাচনিব্যবস্থা গলদমুক্ত করতে কাজ করছে। এতে খানিকটা সময় লাগছে বটে; কিন্তু দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এরই মধ্যে একটি নির্বাচনি পথনকশা ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। অথচ প্রধান উপদেষ্টা দেশে একটি অর্থবহ নির্বাচন আয়োজনে ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠানের তার দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা বারবার ব্যক্ত করছেন। গতকালের সংবাদপত্রেও দেখা গেছে, তিনি জাপানের রাজধানী টোকিওতে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাপান-বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফ্রেন্ডশিপ লিগের প্রেসিডেন্ট তারো আসোর সঙ্গে সাক্ষাতেও একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
আমরা মনে করি, ফ্যাসিবাদ-উত্তর দেশের মানুষ যেমন অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, ঠিক তেমনিভাবে আধুনিক সময়ের একটি টেকসই বাংলাদেশ দেখার আকাঙ্ক্ষায় রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারও চান। সাথে সাথে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী জমানার সব অপকর্মের বিশেষ করে গুম-খুন এবং জুলাই গণহত্যার ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন। কোনো অজুহাতে নাগরিকদের এই চাওয়া পূরণ না হলে আবার জনহতাশা ভিন্নভাবে বিস্ফোরিত হতে পারে। সেটি কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। একটি নির্বাচিত সরকারের অপরিহার্যতার কথা স্বীকার করেও বলা যায়, দেশের বর্তমান এই সন্ধিক্ষণে নির্বাচনই একমাত্র সারকথা নয়। উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলোও গভীর বিবেচনার দাবি রাখে। তবে নির্বাচনের একটি পথনকশা প্রণয়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সংলাপ হওয়া জরুরি। এতে কার্যকর পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর হবে। ফলে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে তৈরি হবে বৃহত্তর সমঝোতার পথ।