ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সংকট উত্তরণে জাতীয় সরকার গঠনের বিকল্প নেই

অধ্যাপক নেয়ামুল আহসান পামেল
সংকট উত্তরণে জাতীয় সরকার গঠনের বিকল্প নেই

মানুষের প্রত্যাশা ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশ! প্রয়োজনে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সংস্কার করে হলেও রাষ্ট্রীয় সংস্কারের বিকল্প নেই। রাজনৈতিক এই সন্ধিক্ষণে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে দেশে বিএনপির মতো বড় দলের জন্যও উভয় সংকট!

প্রয়োজনীয় সংস্কার না করে অর্থবহ নিরপেক্ষ নির্বাচন করা কী সম্ভব? ১৭ বছরের ফ্যাসিস্টের প্রেতাত্মারা এখনও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে! এই চিহ্নিত আমলাদের ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই অপসারণ করলে প্রতিনিয়ত নানামুখী ষড়যন্ত্র ও সমস্যাগুলো সৃষ্টি করছে তা কখনওই করতে পারত না। মনে রাখতে হবে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের ‘র’-এর যন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল দীর্ঘ সময় আন্দোলন করে তাদের জনপ্রিয় নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারেনি। ফেসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিগতনির্বাচন কেন্দ্রিক জোটবদ্ধ বিভিন্ন কৌশলগত আন্দোলন করেও সফলতা পায়নি। শেখ হাসিনার অতি দাম্ভিকতা দলীয় নেতা কর্মীদের লুটপাট অর্থপাচার দুর্নীতি স্বেচ্ছাচারিতা দেশকে এক চরম সংকটের মুখে নিয়ে গেলেও কার্যত ফলপ্রসূ কোনো আন্দোলন করতে না পেরে ব্যর্থতায়, ওবায়দুল কাদেররা উপহাসের হাসি হাসছিল। অবশেষে নিয়তির নির্মম পরিহাস ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার স্বভাব সুলভ দাম্ভিক বক্তব্য কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জ্বলন্ত আগুনে পেট্রোল ঢেলে দেওয়ার মতো দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে! সুযোগ বুঝে ছাত্রদের সঙ্গে এদেশের বিপ্লবী জনতা ও সব রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনে যুক্ত হলে কোনোভাবেই শেখ হাসিনার সরকার আর রক্ষা পায় না। যার চরম মূল্য দিতে হয় ৫ই আগস্টে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর মধ্য দিয়ে! ১৭বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে!

জুলাই, আগস্ট বিপ্লবের পর দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি মনে করেছিল ক্ষমতায় তো এসে গেছি! শুধু সময়ের ব্যাপার। আংশিক ক্ষমতা পেয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার চাঁদাবাজি দুর্নীতির মাঝে ডুবে ফ্যাসিস্টদের আশ্রয় দিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে এ দলের অনেক নেতাই দলের কাছে এবং জনগণের কাছে চিহ্নিত হয়ে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবদ্ধ করে তোলে। দেশের সাধারণ মানুষ এখন অনেক রাজনৈতিক সচেতন। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার সঙ্গে দেশের বড় বড় সব রাজনৈতিক মিত্রদলগুলো এখন নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করছে! ফ্যাসিস্টের একদিকে বিচার দাবি করছে অন্যদিকে খোলস পরিবর্তন করে এদেরই নিজেদের দলে ভিরিয়ে নেতাকর্মী বানানোর প্রতিযোগিতা চলছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যারা ১৭ বছরের দুঃশাসনের লড়াইয়ের সঙ্গে জড়িত থেকে জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছে।

অথচ হাসিনা সরকারের পালিয়ে যাওয়ার পরেই দেশে আওয়ামী দখলদারিত্বের বিপরীতে পাল্টা দখলের বাণিজ্য শুরু করে বিএনপির মতো বড় দলসহ কিছু ইসলামি দলও অতি দ্রুত বিতর্কিত হয়ে জনগণ হতাশ করছে।

অন্তর্বর্তী সরকারে অনেক বিতর্কিত অদক্ষ উপদেষ্টা থাকলেও ফ্যাসিস্ট হাসিনার লুটপাট অর্থপাচার রাষ্ট্রকে অন্ধকারে নিমজ্জিত অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডহীন করে তোলে। এ কথাও অস্বীকার্য যে, এই রাষ্ট্রকে পরিচালনার জন্য দেশ ও আন্তর্জাতিক মহলে সর্বজন গ্রহণযোগ্য প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূসের বিকল্প ছিল না।

১৭ বছরের স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান ঘটেছে। দেশ আবার গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসুক, এটা সবার কামনা।

ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল স্বমহিমায় জুলাই বিপ্লবের চেতনার অঙ্গীকারকে সমুন্নত রেখে এগিয়ে যাক। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ সুবিধা নিয়ে সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিতর্কিত করা ঠিক হবে না। সরকারকেও তার নিরপেক্ষতার প্রশ্নে কোনো দলকে বিশেষ সুবিধা না দিয়ে, সব রাজনৈতিক দলের কাছে আস্থাভাজন হিসেবে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার রাখা উচিত।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এখনও দেশের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনায় যাওয়ার মতো নিঃসন্দেহে সম্ভাব্য দল। বর্তমান প্রফেসর ইউনূস সরকারের সঙ্গে বিএনপি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মতো আচরণ দেশকে একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে। আবারও ১/১১’র মতো একটি সরকারের জন্ম দিতে পারে, যা নিঃসন্দেহে কারও জন্য মঙ্গলজনক হবে না। তাই বিএনপির উচিত আলোচনার মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশলী প্রচেষ্টা অবলম্বন করা।

১৭ বছরে ভারতের আজ্ঞাবহ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের কারণে বাংলাদেশের ৮০ ভাগ মানুষ ভারতবিরোধী হয়ে উঠেছে। প্রফেসর ডক্টর ইউনূসের সরকার ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের বিপরীতে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতের করালগ্রাস থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা দেশের মানুষকে প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূস সরকারের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস বৃদ্ধি করেছে।

মানুষের এই মনোভাবের বাহিরে ভারতের আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক মনোভাব পোষণকারী দলকে এদেশের মানুষ কখনওই ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। তাই ভারত যখন দ্রুত নির্বাচনের কথা বলে, তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে যেসব রাজনৈতিক দল কথা বলবে তাদেরও ভারতের দালাল মনে করে মানুষ তাদের থেকে দূরে সরে যাবে।

দেশের এই রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ ও সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র বিকল্প পথ তিন বছরের জন্য জাতীয় সরকার গঠন করা। এই সরকারে ড. মো. ইউনূসের নেতৃত্বে সংখ্যানুপাতে বৃহত্তর দলগুলোর সম্মানজনক সংখ্যক সরকারে অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করে দায়িত্ব বণ্টন করা। এই সরকার স্বাধীনতার ৫৪ বছরের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা ও জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের শহিদদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা জানিয়ে তাদের অঙ্গীকার দেশের ছাত্র শিক্ষক পেশাজীবী জনতার বৈষম্য দূর করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করা।

এই সরকারের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হবে ১৭ বছরের দুঃশাসনের মাধ্যমে হত্যা খুন গুম আয়না ঘরের লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড অত্যাচার জুলাই বিপ্লবের শহিদ ও আহতসহ নির্যাতনকারীদের বিচার করা। দ্বিতীয়ত, দেশের বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন বৈষম্যমুক্ত স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষা স্বাস্থ্য নীতি তৈরি করে সব ক্ষেত্রে নৈরাজ্য লুটপাট দুর্নীতি বন্ধের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তৃতীয়ত, নির্বাচনকালীন সরকার নির্বাচন কমিশনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা।

সর্বোপরি রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করে বৈষম্যহীনভাবে সব পেশার মানুষের সম অধিকার নিশ্চিত করা। স্বাধীন নিরপেক্ষ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

লেখক : শিক্ষক নেতা, লেখক, সাংবাদিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত